অম্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
বিষকে যদি অমৃতে রূপান্তর করা যায়! লক্ষ্য এ রকমই। বায়ুমণ্ডলে ক্রমবর্ধমান ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাসের উপস্থিতি ও তার জেরে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চিন্তায় গোটা বিশ্ব। এই অবস্থায় একদল বিজ্ঞানী এমন একটি পথ খুঁজে পেলেন, যা কি না বায়ুমণ্ডলের অত্যন্ত বিপজ্জনক গ্রিনহাউস গ্যাস মিথেনকে বদলে ফেলতে পারে কম ক্ষতিকর কিংবা প্রয়োজনীয় অন্য কোনও রাসায়নিকে। তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘সায়েন্স’ জার্নালে।
গবেষকদলটির মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা, যাঁদের মধ্যে অন্যতম বাঙালি বিজ্ঞানী অম্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। এই গবেষণায় উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে কাজ করেছে সুইৎজ়ারল্যান্ডের পল শেরার ইনস্টিটিউট, সুইডেনের স্টকহোম ইউনিভার্সিটি, জার্মানির হামবুর্গ ইউনিভার্সিটি ও ‘ইউরোপিয়ান এক্সএফইএল’। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এক্স-রে আলো ফেলে তার সাহায্যে মিথেনকে কম ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থে রূপান্তরিত করার ক্ষমতাসম্পন্ন কার্যকর অনুঘটক তৈরির রাস্তা খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা। এই রাস্তা সহজ নয়। এক ধাপ, এক ধাপ করে এগিয়েছে বিজ্ঞান, সেই সঙ্গে বিজ্ঞানীরাও।
১৮৯৫ সালে জার্মানিতে বিজ্ঞানী উইলিয়াম কনরাড রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করেছিলেন। এক্স-রে-র সাহায্যে সর্বপ্রথম স্ত্রীর হাতের ছবি তুলেছিলেন তিনি। এক্স-রে বিষয়টি এখন আর কারও অজানা নেই। যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না, তাকে দৃশ্যমান করে তোলে এই রশ্মি। এটির উপর ভিত্তি করে ‘এক্স-রে অ্যাবসর্পশন স্পেকট্রোস্কোপি’ নামের প্রযুক্তির সাহায্যে বিজ্ঞানীরা আণবিক স্তরে অদৃশ্য কোয়ান্টাম জগতে চোখ রেখেছেন। সুইৎজ়ারল্যান্ডের পল শেরার ইনস্টিটিউটে দু’টি পরীক্ষায় গবেষকেরা রোডিয়াম অনুঘটক এবং একটি অক্টেনে কার্বন-হাইড্রোজেন গ্রুপের মধ্যে ইলেকট্রনের বিনিময় অনুসরণ করতে পেরেছেন। বিষয়টা জরুরি, কারণ অক্টেনের মতো আর একটি যৌগ মিথেনের কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ড ভাঙতে পারে রোডিয়াম। প্রায় ৪০ বছর আগে এ কথা জানা গিয়েছিল। কিন্তু এর পিছনে থাকা রসায়ন এত দিন ‘রহস্য’ হয়ে ছিল। এটুকুই জানা ছিল, আলো ফেলা মাত্র রোডিয়াম সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং মিথেনের কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ড ভেঙে দেয়। নতুন গবেষণায়, এর আড়ালে থাকা আণবিক স্তরের রসায়ন পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। যার সাহায্যে ভবিষ্যতে ক্ষতিকর মিথেন গ্যাসকে কাবু করতে পারবেন বলে আশাবাদী বিজ্ঞানীরা।
উত্তরপাড়ার ছেলে অম্বর। কলকাতার রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের প্রাক্তন ছাত্র অম্বর বর্তমানে সুইডেনবাসী। তিনি বলেন, ‘‘যখন তেলের খনি থেকে তেল তোলা হয়, দেখা যায় উপরে আগুন জ্বলছে। ওটি মিথেন গ্যাস। এই গ্যাস খুব হাল্কা। একে এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া কঠিন। তাই ক্ষতিকর গ্যাসটিকে পুড়িয়ে ফেলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও জল তৈরি করা হয়। কার্বন-ডাই-অক্সাইডও ক্ষতিকর, কিন্তু মিথেনের থেকে কম। তবে এই পদ্ধতিতে আদপে শক্তির অপচয় হয়।’’ নতুন পদ্ধতিতে ক্ষতিকর মিথেনকেও ‘কার্যকরী’ করে তুলতে পারবেন বলে দাবি তাঁদের।
উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর এক বিজ্ঞানী, এই গবেষণার প্রধান এক্সপেরিমেন্টালিস্ট রাফায়েল জের জানিয়েছেন, অনুঘটকটি (রোডিয়াম) একটি ঘন অক্টেন দ্রবণে নিমজ্জিত করা হয়েছিল। ধাতুর প্রকৃতি পরীক্ষা করে সেই অনুযায়ী তাঁরা কয়েক হাজার কার্বন-হাইড্রোজেন (C-H) বন্ড-এর মধ্যে থেকে যে বিশেষ কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ডটিকে ভাঙা দরকার, সেটিকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। অম্বর বলেন, ‘‘আমরা দেখিয়েছি, কী ভাবে C-H বন্ড থেকে ধাতুর উপর প্রবাহিত চার্জ আঠার মতো কাজ করে ও দু’টি রাসায়নিক গ্রুপকে একত্রিত করে। আবার ধাতু থেকে C-H বন্ডের দিকে প্রবাহিত চার্জ একটি কাঁচির ন্যায় কাজ করে শেষ পর্যন্ত কার্বন এবং হাইড্রোজেন, এই দু’টি অণুকে আলাদা করে দেয়।’’