হিন্দুজা পরিবারের সেই সদস্যেরা। ছবি: সংগৃহীত।
তাঁরা ভারত থেকে সামান্য বেতনে লোক নিয়ে এসে তাঁদের প্রাসাদোপম বাড়িতে গৃহ পরিচারকের কাজ করাতেন। পরিণত করতেন কার্যত ক্রীতদাসে! শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে দৈনিক ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানো হত। সামান্য ভুলচুক করলেই সেই পরিচারকদের অত্যাচারের শিকার হতে হত।
সেই অপরাধে এ বার অনাবাসী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ধনকুবের পরিবার হিন্দুজাদের চার সদস্যকে জেলের সাজা দিল সুইৎজ়ারল্যান্ডের জেনিভার একটি আদালত। বর্তমানে সুইস নাগরিক হিন্দুজা পরিবারের দণ্ডিতেরা হলেন— প্রকাশ হিন্দুজা, তাঁর স্ত্রী, ছেলে ও পুত্রবধূ। কারাদণ্ডের সর্বোচ্চ মেয়াদ সাড়ে চার বছর। সাজা ঘোষণার সময়ে তাঁরা কেউই আদালতে ছিলেন না। তাঁদের আইনজীবী জানান, উচ্চ আদালতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন জানানো হবে।
হিন্দুজা পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, জেনিভায় হ্রদের ধারে বিলাসবহুল বিশাল ভিলায় কাজ করার জন্য তাঁরা ভারত থেকে মানব পাচারের মাধ্যমে গৃহসহায়ক, গৃহসহায়িকা এবং পাচক নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের দিয়ে অমানবিক পরিশ্রম করাতেন। অন্তত ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হত। বাড়িতে কোনও ভোজসভা বা আমোদ-প্রমোদ চললে, কাজ করতে হত ভোররাত পর্যন্ত। রান্নাঘরের মেঝেতেই চাদর পেতে শুতে হত তাঁদের। কোনও ছুটি দেওয়া হত না, এমনকি তাঁদের ভিলার বাইরে পা রাখতেই দেওয়া হত না। তাঁদের মাইনের টাকা সরাসরি, ভারতীয় মুদ্রায়, ভারতের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হত। এবং তাঁদের যে পারিশ্রমিক দেওয়া হত, তা সুইৎজ়ারল্যান্ডে এ ধরনের কাজের জন্য যে অর্থ পাওয়া যায়, তার দশ ভাগের এক ভাগও নয়!
অভিযোগ, হিন্দুজা পরিবারে দৈনিক ১৮ ঘণ্টার কাজ করা পরিচারকদের জন্য দিনপ্রতি বরাদ্দ থাকত ৬.১৯ পাউন্ড। অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রার হিসাবে ৬৫৭.৬৪ টাকা। গোটা বছরের হিসাব করলে দাঁড়ায় ২২৫৯.৩৫ পাউন্ড বা ভারতীয় মুদ্রায় দু’লক্ষ ৪০ হাজার টাকার কিছু বেশি। অথচ পোষা কুকুরের জন্য বছরে ৭৬১৬ পাউন্ড ব্যয় করেন হিন্দুজারা। ভারতীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ আট লক্ষ ন’হাজার ১৪৩ টাকা! অর্থাৎ, এক জন পরিচারকের বাৎসরিক বেতনের প্রায় চার গুণ! সওয়াল-জবাবের সময়ে সরকারি পক্ষের আইনজীবী আদালতে জানিয়েছিলেন সে কথাও।
ভারত থেকে যাওয়া ওই পরিচারকদের বেশির ভাগই শুধু হিন্দিভাষী। অন্য বিদেশি ভাষা জানতেন না। তাঁদের পাসপোর্টও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল বলে আদালতে জানিয়েছেন সরকারি আইনজীবী। তাঁর কথায়, ‘‘বিদেশে এসে, বাইরের জগতের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয় গিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাতেন তাঁরা।’’ মানব পাচার ছাড়া বাকি সব ক’টি ধারায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন হিন্দুজা পরিবারের চার সদস্য। তাঁদের বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে আদালত জানিয়েছে, যাঁরা ভারত থেকে এখানে কাজ করতে এসেছিলেন, তাঁরা জেনে-বুঝেই এসেছিলেন যে, তাঁদের কী ধরনের কাজ করতে হবে।
তবে হিন্দুজারা যে সে দেশের মানবাধিকার এবং শ্রমবিষয়ক আইন লঙ্ঘন করেছেন এবং গৃহসহায়কদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেছেন, তা মেনে নেন বিচারকেরা। প্রকাশ হিন্দুজা ও তাঁর স্ত্রী কমলের সাড়ে চার বছর জেল হয়েছে। প্রকাশের ছেলে অজয় ও পুত্রবধূ নম্রতাকে চার বছর কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। মামলা চালানোর খরচ ও সম্ভাব্য জরিমানা হিসেবে হিন্দুজাদের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই হিরে, চুনি ও প্ল্যাটিনামের নেকলেস-সহ প্রচুর অলঙ্কার বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ।
ওই মামলায় পঞ্চম অভিযুক্ত, হিন্দুজা পরিবারের ব্যবসা-সংক্রান্ত ম্যানেজার নজিব জ়িয়াজ়ির ১৮ মাসের কারাদণ্ডের সাজা কমানো হয়েছে। জেলে না গিয়ে তাঁকে ১৮ মাস প্রোবেশনে কাটাতে হবে। গৃহসহায়কদের বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে গত সপ্তাহেই তাঁদের মামলা তুলে নিতে বাধ্য করিয়েছিলেন হিন্দুজারা। তার পরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করে সুইস পুলিশ। প্রসঙ্গত, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ধনকুবের হিন্দুজাদের সম্পত্তির পরিমাণ ৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩ লক্ষ ৯৩ হাজার কোটি টাকার সমান।