মমতার স্পর্শ। ইডেনে নাইট-বরণ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা শাহরুখের। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
স্লোগানটা শুনে প্রথম বার একটু থমকে গিয়েছিল ইডেন। তার পরেই উত্তাল গর্জন।
মঙ্গলবার দুপুরের ইডেনে মুহুর্মুহু শোনা গেল, ‘অব কি বার কেকেআর...!
মঞ্চে তখন বিরস মুখে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মালুম হচ্ছিল, গান-স্লোগানে মন নেই তাঁর। নির্ধারিত সময়ের অন্তত ঘণ্টা দুই পরে শাহরুখ খান ইডেনে ঢোকা ইস্তক থমথমে মুখেই দেখা গেল মুখ্যমন্ত্রীকে।
বলিউড বাদশার ‘লাইভ শো’ দেখার অপেক্ষায় সকাল থেকে হত্যে দিয়ে পড়ে ছিল মাঠ-ভরা জনতা। অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময় দুপুর একটা হলেও বেলা দশটাতেই প্রায় হাজার তিরিশ দর্শক ঢুকে পড়েন গুমোট গ্রীষ্মের ইডেনে। তাদের মাতিয়ে রাখতে মোদীর স্লোগান ধার করে ‘অব কি বার কেকেআর’ বলেই গান ধরেন ঊষা উত্থুপ। পরে অন্য শিল্পীদের মুখেও ঘুরে-ফিরে আসে ‘অব কি বার...’! সদ্য ভোটে জয়ী দেব এ দিন সংসদ ভবনে ছিলেন। তাই তাঁকে ইডেনে দেখা যায়নি। কিন্তু প্রসেনজিৎ, সোহম, শ্রাবন্তী, রুদ্রনীল, মিমি, হিরণ, গায়ক সৌমিত্র রায় থেকে সিরিয়ালের বাহা-ঝিলিক-টুসু-পরী-মৌরিরা সকলে ছিলেন।
কিন্তু শাহরুখ কোথায়? বিমান ছাড়তে দেরির কথা জানিয়ে তিনি তখন পরপর টুইট করে যাচ্ছেন।
এখানে ঊষা উত্থুপের ‘উরি উরি বাবা, কেকেআর’-এর সঙ্গে নাচে সামিল হলেন প্রসেনজিৎ ও জুহি চাওলা। আবদারের ঠেলায় ইউসুফ পাঠান, পীযূষ চাওলাদেরও খানিক ক্ষণ কোমর দোলাতে হল। মঞ্চের নীচে বর্ধমানের ঢাকি বা বাঁকুড়ার সাঁওতাল নাচের লোকশিল্পীরাও হাজির। বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ এলেন মমতা। শাহরুখের অনুপস্থিতিতেই খোলা জিপে এক দফা ‘ভিকট্রি ল্যাপ’ হয়ে গেল নাইটদের। বিমান-বিভ্রাটের জন্য শাহরুখের দেরি হচ্ছে বলে জানিয়ে অপেক্ষমাণ জনতার কাছে ক্ষমা চাইলেন মমতা। শেষমেশ বিকেল চারটে নাগাদ শাহরুখ ঢোকার পরেই দিদির মুখে হাসি ফুটল।
কলকাতা নাইট রাইডার্স-এর সিইও বেঙ্কি মাইসোর পরে বলছিলেন, “শাহরুখের ইডেন পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে যাবে জেনে মমতাদিদি তো বলেই দিয়েছিলেন, উনি অত ক্ষণ থাকতে পারবেন না। ওঁকে বিকেলের মধ্যে কলকাতা ছাড়তে হবে। পরে উনি মত পাল্টান।”
অনুষ্ঠান সেরে ইডেনের ড্রেসিংরুমে শাহরুখ নিজেও বললেন, কলকাতায় আসতে দেরি নিয়ে টেনশনে পড়ার কথা। তাঁর কথায়, “সোমবার অনেক রাতে বেঙ্গালুরু থেকে মুম্বইয়ে ফিরেছি। বাড়িতে আমার মেয়ে একা ছিল। এ দিন দুপুরে বিমানবন্দর থেকে চার্টার্ড ফ্লাইট ছাড়তেও দেরি হল।” শাহরুখ জানান, গোপীনাথ মুন্ডের আকস্মিক মৃত্যুর পরে মুম্বই থেকে অনেকেই বিশেষ বিমানে দিল্লি যাচ্ছিলেন। তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছিল। ফলে, শাহরুখের কলকাতাগামী চার্টার্ড বিমানটির রওনা হতে দেরি হয়। তাঁকে দেড় ঘণ্টা বিমানবন্দরে বসতে হয়।
তবে কলকাতাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখলেও শেষ পর্যন্ত নিরাশ করেননি বাদশা। মঞ্চে উঠে গায়ক সৌমিত্র রায়ের হাত থেকে মালয় যন্ত্র গেন্ডাং (অনেকটা বাংলার ডুবকির আদলে) কেড়ে নিয়ে বাজাতে শুরু করলেন। নিজের হিট গান ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর’-এর সঙ্গে তুমুল নাচ, ট্রফি নিয়ে সদলে ইডেন পাক খাওয়া তো আছেই। কলকাতার জন্য বলিউডের একটি পুরনো সংলাপকেও শাহরুখ এ দিন পাল্টে দিয়েছেন। ‘ডন’-এর সংলাপটা প্রথমে ঊষাই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। ‘নাইট রাইডার্স কো পকড়না মুশকিল হি নেহি, না-মুমকিন হ্যায়’। তার সূত্র ধরে ‘ডন’ মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন, “ডন কো অগর কোই পকড় সকতা হ্যায় তো উও কলকাতা নাইট রাইডার্স কে সাপোর্টার্স হ্যায়!”
কলকাতার ক্রিকেট-আবেগকে দরাজ শংসাপত্র দিয়ে শাহরুখ বলেছেন, “আর কোনও শহর বা রাজ্যই তাদের খেলার মাঠের হিরোদের এমন সম্মান দিতে জানে না!” আর অনুষ্ঠানের আয়োজক মমতা-দিদির উদ্দেশে তাঁর প্রিয় ভাইয়ের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, “মমতা দিদির জন্য বরাবর এই শহরটা নিজের বাড়ি মনে হয়। থ্রি চিয়ার্স ফর মমতাদি! হিপ হিপ হুর্রে!”
নাইটদের দুরন্ত জয়ের পটভূমিতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরের সাক্ষাৎ নিয়ে আম বাঙালির জল্পনা আগেই দানা বাঁধছিল। দু’বছর আগে কেকেআর-এর প্রথম আইপিএল জয়ের উদ্যাপনেই দিদির কপালে চুমু খেয়ে ভাই শাহরুখের আবদার ছিল, “পরের বার কিন্তু আপনাকেও আমাদের সঙ্গে নাচতে হবে!” এ বার আবেগ অন্য মাত্রা পেয়েছে। মমতাকে নাচবার জন্য পীড়াপীড়ি করেননি ঠিকই। কিন্তু সন্দেশের ঢাউস কেকটা কেটে প্রথম টুকরোটা দিদির মুখেই গুঁজে দিয়েছেন। আইপিএল-এর ট্রফিও মমতার হাতে দিয়েই ছবি তুলেছেন। ট্রফিতে মুখ ঢেকে যাচ্ছিল মমতার, সে-দিকে খেয়াল রেখে কী ভাবে সেটা ধরতে হবে দিদিকে দেখিয়ে দেন শাহরুখ।
শাহরুখ ঢোকার আগে গৌতম গম্ভীরদের পুরস্কার দিতে কিন্তু সামনে আসেননি মমতা। আলোকচিত্রীদের নাগালের বাইরে এক ধারে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছিলেন, ‘ডালমিয়াজি আপনি (জগমোহন ডালমিয়া) বাকি প্লেয়ারদের কনগ্র্যাচুলেট করুন, শাহরুখ এলে ওরটা আমরা দিয়ে দেব।’ জুন (মালিয়া) তুমি নামগুলো বলতে থাক!” শাহরুখ আসার ঠিক আগে মুখ্যমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ফিরহাদ হাকিমদের স্টেডিয়মের বাইরে পাঠান তাঁকে স্বাগত জানাতে। এর পরেই চেনা মেজাজে ফেরেন মমতা। অনুষ্ঠানের রাশ হাতে রেখে গলা চড়ান ‘অত্রি (তথ্য-সংস্কৃতি সচিব অত্রি ভট্টাচার্য) চটপট শেষ করো। মদন ডোন্ট টেক টাইম। জুন তাড়াতাড়ি করো, গৌতমের (গম্ভীর) ফ্লাইট আছে। শাহরুখ প্লিজ কাট দ্য কেক।’
কেক কাটার পরে মমতাই শাহরুখদের ‘গো অ্যারাউন্ড দ্য গ্রাউন্ড’ বলে মাঠ প্রদক্ষিণ করতে পাঠান। তত ক্ষণে মাঠে ভিড় করা আমলা, নেতা, সিএবি-কেকেআরের কর্মকতাদের প্রতি তাঁর ফের নির্দেশ, “যাঁরা মাঠের মাঝখানে আছেন সাইড হয়ে যান, বসে পড়ুন।” মঞ্চে কারা থাকবেন, তাও ঠিক করে দেন মুখ্যমন্ত্রীই। “ঊষাদি তুমি পুরো টিম নিয়ে স্টেজে চলে যাও। তুমি একটু গান গাইবে আর শাহরুখ পুরো টিম নিয়ে মাঠে ঘুরবে।” এবং মাইক হাতে গোটা মাঠকে শুনিয়ে তাঁর সগর্ব ঘোষণা, “পুলিশের থেকে আমি ভাল কন্ট্রোল করতে পারি, তবে ওরাও অনেক করেছে।”
মাঠের বাইরে অবশ্য এ দিন কাজ করেনি এই ‘কন্ট্রোল’। টিকিট পাওয়া এবং টিকিট না-পাওয়া জনতার মরিয়া ভিড় সামলাতে হিমশিম খেয়েছে পুলিশ। লাঠির বাড়ি, ঘোড়ার গুঁতো, ব্যারিকেডের দেওয়াল ভেঙে বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছয়। রাতে মমতা যখন ফেসবুকে নাইট-বরণ উৎসবের ছবি আপলোড করেছেন, অনেকেই তাঁদের ‘কমেন্টে’ মাঠের বাইরের ছবিটার কথা তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছেন।
সব কিছু নিজে ‘কন্ট্রোল’ বা দেখভাল করবেন বলেই উত্তরবঙ্গ সফর অসমাপ্ত রেখে বিমান ভাড়া করে সোমবার কলকাতা ফিরে এসেছিলেন মমতা। অনুষ্ঠানের পরেই তাঁর বিমান ধরে ফেরার কথা ছিল। তাই শাহরুখ আসতে বিকেল গড়াচ্ছে দেখে মুখ্যমন্ত্রীর হাবভাবে টেনশনও ফুটে উঠছিল। শেষমেশ অনুষ্ঠান শেষ করেই ইডেন ছাড়েন মুখ্যমন্ত্রী। বিশেষ বিমানে হাসিমারা ফিরে যান তিনি।
মঞ্চ ছাড়ার আগে মুখ্যমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেন শাহরুখ। পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন। আবেগঘন মুহূর্তটার ছোঁয়াচ মমতাও এড়াতে পারেননি। শাহরুখের দিকে তাকিয়ে হাত মুঠো করে শূন্যে ছুড়ে দেন তিনি। শাহরুখও একই ভঙ্গিতে সম্ভ্রম প্রকাশ করেন। মুখ্যমন্ত্রীর হাতে চুমু খেয়ে বিদায় নেন বাদশা।