দলের ছাত্র সংগঠনের বিশৃঙ্খল নেতা-কর্মীরা নন, একের পর এক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলার ঘটনা জনসমক্ষে তুলে ধরায় এ বার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোপে পড়ল সংবাদমাধ্যমের একাংশ। শুক্রবার শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্য, শিক্ষাঙ্গনে দু’-একটি খারাপ ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সে জন্য ১০০ ভাগ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘আক্রমণ’ করা চলবে না।
শিক্ষাক্ষেত্রে দৌরাত্ম্যের জন্য গত তিন বছরে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) দিকে আঙুল উঠলেই সরকারের তরফে তাকে লঘু করে দেখানো হয়েছে। একবার নয়, বারবার। আড়াই বছর আগে রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে অধ্যক্ষকে মারধর, ধাক্কাধাক্কির ঘটনাকে ‘ছোট্ট ঘটনা’ এবং ‘ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের ভুল’ বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। তার পর থেকে কখনও টোকাটুকির দাবিতে গোলমাল করে, কখনও ইউনিয়ন ফি-বাবদ টাকা আদায় করে, কখনও বা মেধাতালিকা এড়িয়ে পছন্দের ছাত্রভর্তির জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপরে চাপ তৈরি করে শিরোনামে এসেছে টিএমসিপি। বেশির ভাগ ঘটনাতেই অধ্যক্ষ ঘেরাও, ভাঙচুর করা হয়েছে কলেজে।
দৌরাত্ম্য এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে ইস্তফাও দিয়েছেন একাধিক অধ্যক্ষ বা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।
কিন্তু সরকারের তরফে শাসক দলের ছাত্রসংগঠনকে সংযত করার কোনও চেষ্টাই হয়নি। গত ২৮ অগস্ট গাঁধী মূর্তির পাদদেশে টিএমসিপি-র প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে দলের ছাত্র সংগঠনের সমর্থকদের সামনে পেয়েও তাঁদের সংযত হওয়ার কোনও বার্তা দেননি মুখ্যমন্ত্রী।
সেই মুখ্যমন্ত্রীই কিন্তু শুক্রবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে শিক্ষক দিবসের সরকারি অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে সংবাদমাধ্যমকে নিশানা করলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অশান্তির অভিযোগ উড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মতে, এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম শিক্ষার ভাল চায় না। তাঁর কথায়, “শিক্ষা মানেই এরা দেখায় যে অশান্তি হচ্ছে! কীসের অশান্তি বলুন তো শিক্ষক-শিক্ষিকা বন্ধুরা আমার!” এর পরেই তিনি বলেন, “একটা-দু’টো খারাপ ঘটনা ঘটলে সেটা নিশ্চয়ই খারাপ। সে জন্য আইন ও প্রশাসন আছে, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু একটা-দু’টো ঘটনার জন্য ১০০ ভাগ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণ করা ঠিক নয়।”
মুখ্যমন্ত্রী যা-ই বলুন, পরিসংখ্যান বলছে, গত এক মাসে কেবল মেদিনীপুর জেলাতেই তিনটি কলেজে গোলমাল হয়েছে। সবগুলিতেই অভিযোগ মূলত টিএমসিপি-র দিকে। যার মধ্যে দু’টি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষেরা ইস্তফা পর্যন্ত দিয়েছেন। নদিয়ার বাঙালঝি ও কৃষ্ণনগর
বিপ্রদাস পাল চৌধুরী আইটিআই-এ টোকাটুকির দাবিতে অধ্যক্ষের উপরে চড়াও হয় ছাত্র সংসদ। সম্প্রতি ছাত্র অসন্তোষের জেরে ইস্তফা দিয়েছেন জঙ্গিপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। শিক্ষক দিবসের ঠিক আগের দিন, বৃহস্পতিবার সকালেও কলেজের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল খিদিরপুর কলেজের টিএমসিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদ। ওই দিনই রানিগঞ্জ টিডিবি
কলেজে ছাত্র-সংঘর্ষ রুখতে গিয়ে টিএমসিপি-র হাতে তালাবন্দি হতে হয়েছিল পুলিশকে।
ছাত্র সংসদগুলির দাপাদাপি রুখতে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সংযত হওয়ার বার্তা দিয়ে সতর্ক করেছেন। টিএমসিপি-র মাথায় একটি উপদেষ্টা মণ্ডলীও বসিয়েছে শাসক দল। এটুকু ছাড়া বিশেষ কোনও ব্যবস্থাই এ পর্যন্ত নেয়নি সরকার। তার উপরে মুখ্যমন্ত্রীও যে ভাবে ঘটনাগুলিকে লঘু করে দেখেছেন, তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা।
প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “একটা-দু’টো ঘটনা তো ঘটেনি! প্রতি সপ্তাহেই কোনও না কোনও গোলমাল হচ্ছে, যেগুলির হোতা টিএমসিপি। সংবাদমাধ্যমের কাজ খবর পৌঁছে দেওয়া। সেটাই তারা করছে। এতে কেউ যদি রেগে যান, তা হলে তা দুর্ভাগ্যজনক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন।” রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার কিছুটা রসিকতার সুরে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী কি অনুবীক্ষণের উল্টো কোনও যন্ত্র পেয়ে গিয়েছেন, যাতে সব কিছুই ছোট ও কম দেখায়? এত গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, আর উনি যে ভাবে তা ব্যাখ্যা করছেন, সেটা দুর্ভাগ্যজনক।” উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অরুণাভ বসু মজুমদার, যিনি তৃণমূল সরকারের আমলেও বছর দেড়েকের বেশি ওই পদে ছিলেন, বলেন, “সর্বত্র দলতন্ত্র কায়েম করার যে চেষ্টা চলছে, তা অকল্পনীয় ও ভয়াবহ। যে অধ্যক্ষই সেটা মানছেন না, তাঁকে সরে যেতে হচ্ছে। কোথাও স্বশাসন নেই। আর সংবাদমাধ্যম এ সব লিখবে না? সাধারণ মানুষ তা হলে জানবেন কী করে? মুখ্যমন্ত্রীই বা সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে এমন কথা বলেন কী করে!”