রাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে দূত হিসেবে স্মৃতি ইরানিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঠিক হয়েছে, আগামী মাসের ৪ তারিখ কলকাতায় এসে মমতার সঙ্গে বৈঠক করবেন স্মৃতি। মমতার সঙ্গে তাঁর এ নিয়ে ফোনে এক প্রস্ত কথাও হয়েছে।
ক্ষমতায় আসার পরে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই যোগাযোগ গড়ে তুলছেন মোদী। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার ভার তিনি দিয়েছেন রবিশঙ্কর প্রসাদের হাতে। বেঙ্কাইয়া নায়ডুকে দেওয়া হয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব। মমতার ক্ষেত্রে স্মৃতিকে বেছে নেওয়ার একটা কারণ বাংলার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। স্মৃতির মা বাঙালি। স্মৃতি নিজেও ঝরঝরে বাংলা বলেন।
প্রশ্ন হল, মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে এই সেতুবন্ধনের পিছনে উদ্দেশ্যটা কী?
ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেরই মতে, এখনও পর্যন্ত যা লক্ষণ, তাতে রাজনীতি আর প্রশাসন এ দু’টিকে মোদী আলাদা রাখতে চান বলেই মনে হচ্ছে। বস্তুত, লোকসভা ভোটে বিপুল জয়ের পরেই আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মোদী বলেছিলেন, রাজনীতি আর প্রশাসনকে এক করে ফেলতে চান না তিনি। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকবে। সেখানে বিজেপি নিজের মতো করে চলবে। কিন্তু প্রশাসক হিসেবে তিনি হবেন নিরপেক্ষ এবং মোহমুক্ত। বিভিন্ন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টাকে সেই নিরপেক্ষ প্রশাসকের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
মোদী যদি তাঁর এই অবস্থান বজায় রাখেন, তা হলে আখেরে রাজ্যের লাভ হবে বলেই অনেকের মত। অতীতে অনেক সময়ই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাজনীতি অন্যতম প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিয়েছিল। এ রাজ্যেই ক্ষমতায় থাকাকালীন বামপন্থীরা দীর্ঘদিন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিমাতৃসুলভ আচরণের অভিযোগ তুলেছে। যে অভিযোগের সবটাই নিছক রাজনীতি বলে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। যেমন, জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সল্টলেকে ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স তৈরির জন্য ছাড়পত্র চেয়ে আবেদন করেছিলেন কেন্দ্রের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের কাছে। কিন্তু ইন্দিরা গাঁধী অনুমতি দেননি। খাতায় কলমে তাঁর যুক্তি ছিল, সল্টলেকের কাছেই বাংলাদেশ সীমান্ত। অতএব নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা হবে। কিন্তু প্রকল্প আটকে দেওয়ার আসল কারণ যে বামপন্থীদের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক মতবিরোধ, তা মোটেই চাপা ছিল না।
গত ইউপিএ সরকারের আমলে পড়শি বিহারেও পড়েছিল কেন্দ্র-রাজ্য রাজনৈতিক টানাপড়েনের ছায়া। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার চেয়েছিলেন মোতিহারিতে গড়ে উঠুক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী কপিল সিব্বলের পছন্দের জায়গা ছিল গয়া অথবা পটনা। দীর্ঘ বিবাদের পরে শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, গয়া এবং মোতিহারি, দু’জায়গাতেই বিশ্ববিদ্যালয় হবে।
মোদীর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে বলা হচ্ছে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাজনীতির এই অনুপ্রবেশ প্রধানমন্ত্রী চান না। গোটা দেশকে নিয়ে এগিয়ে চলার কথা তিনি ইতিমধ্যেই বলেছেন। বলেছেন, পশ্চিমের রাজ্যগুলিতে উন্নয়ন হবে আর পূর্বের রাজ্যগুলি পিছিয়ে থাকবে, তাতে সামগ্রিক ভাবে দেশের বিকাশ হতে পারে না।
কিন্তু সহযোগিতার প্রশ্নে নিরপেক্ষ হলেও রাজ্যের সব দাবিদাওয়া মেটানো সম্ভব কি না, তা নিয়ে মোদী প্রশাসনের একাংশের মনেই সংশয় রয়েছে। মমতা প্রশাসনের মূল দাবি, বাম আমলে রাজ্যের ঘাড়ে যে বিপুল ঋণের বোঝা চেপেছে তা কিছুটা লাঘব করা হোক। ইউপিএ সরকারের আমলেই সুদ-আসল শোধের ক্ষেত্রে তিন বছরের স্থগিতাদেশ দাবি করে বারবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং দুই অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ও পি চিদম্বরমের কাছে দরবার করেছিল রাজ্য। কিন্তু রাজ্যের সেই দাবি যুক্তিযুক্ত বলে মেনে নিয়েও তা পূরণ করতে পারেনি ইউপিএ সরকার। তাদের বক্তব্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কোনও একটি রাজ্যকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া সম্ভব নয়। তা হলে অন্য রাজ্যও একই দাবি করবে।
একই সংশয়ে ভুগছে মোদী প্রশাসন। ভোটের আগে ব্রিগেডের সমাবেশে দাঁড়িয়ে ঋণ মকুবের দাবিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের একাংশের বক্তব্য, এটা সত্যি যে আগের বাম সরকারের অপদার্থতার কারণেই রাজ্যের ঘাড়ে এই বিপুল ঋণের বোঝা চেপেছে। কিন্তু রাজ্যের মানুষ যদি সেই অপদার্থতা উপলব্ধি না-করে বারবার তাদেরই নির্বাচিত করেন, তা হলে সেই দায়ও তাদের নিতে হবে।
ফলে রাজনীতির মঞ্চ থেকে রাজনাথ ঋণ মকুবের দাবিকে সমর্থন করলেও তার বাস্তবায়ন হওয়া কঠিন। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও সার্বিক ভাবে ঋণ মকুবের সংস্কৃতিকে একদমই প্রশ্রয় দিচ্ছেন না। তাঁর বক্তব্য হল, সবার আগে ব্যয় সঙ্কোচ করা দরকার। সঙ্গে চাই লগ্নি এবং রাজস্ব আদায় বাড়ানো। একমাত্র এই পথেই আর্থিক স্বাস্থ্য শোধরাতে পারে রাজ্য।
মোদী সরকারের এই রাজনীতি-নিরপেক্ষ প্রশাসনিক পদক্ষেপ সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য কী?
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে তৃণমূল কখনওই আপস করেনি এবং করবেও না কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্য সাংবিধানিক সম্পর্ককে আমরা অশ্রদ্ধা করব কেন?”
মমতা-স্মৃতি বৈঠকে কী হয়, এখন সেটাই দেখার।