কলকাতার অনশন মঞ্চে রুমা দাস। —ফাইল চিত্র
স্কুল সার্ভিস কমিশনের যৌথ মেধা তালিকায় তাঁর নাম উঠেছিল। তার পরেও নিয়োগপত্র না পাওয়ায় কলকাতায় গিয়ে ধর্নায় বসেছিলেন। এসএসসি-র বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন হাইকোর্টে। চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটার আগেই ঘরে ঝুলন্ত অবস্থায় মিলল তরুণীর দেহ।
মৃতার নাম রুমা দাস। তাঁর বাবা তাঁতশ্রমিক। বুধবার বিকেলে নদিয়ার রানাঘাটে রামনগর ১ পঞ্চায়েতের আঁইশতলা লিচুবাগান এলাকার বাড়িতে তাঁর নিথর দেহ মেলে। মৃত্যুর কারণ নিয়ে বাড়ির লোকেরা মুখ খোলেননি। কিন্তু যাঁদের সঙ্গে তিনি আন্দোলনে নেমেছিলেন, সেই সতীর্থদের দাবি, দীর্ঘ অনিশ্চয়তা সহ্য করতে না পেরেই রুমা আত্মঘাতী হয়েছেন। বৃহস্পতিবার এসডিপিও (রানাঘাট) আজহার তৌসিফ বলেন, “কেউ কোনও অভিযোগ করেনি। আমরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করেছি।”
লোকসভা নির্বাচনের মরসুমে এই মৃত্যু নিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই রাজনৈতিক চাপানউতোর শুরু হয়ে গিয়েছে। সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রতিক্রিয়া, “এই সরকারের আমলে কেলেঙ্কারি হয়েছে অনেক। টেট তার মধ্যে একটা। এক পরীক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। লক্ষ ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকার ছিনিমিনি খেলছে। এটা কেলেঙ্কারি আর ব্যর্থতার সরকার।” তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বিষয়টিতে আদৌ গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, “কে কোথায় আত্মহত্যা করছে, কী ভাবে জানব!”
এসএসসি-র নিয়োগে ‘অব্যবস্থা’ নিয়ে গত তিন মাস ধরে ‘ছাত্র ঐক্য সংগ্রাম কমিটি’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে আন্দোলনে নেমেছিলেন রুমা। এ দিন রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালে রুমাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কমিটির তরফে প্রদ্যোৎ হালদার দাবি করেন, “গত ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সল্টলেকে আমাদের ধর্নায় রুমা ছিলেন। হতাশা আর
ব্যর্থতা সহ্য করতে না পেরেই উনি আত্মঘাতী হয়েছেন।”
হাইকোর্টে রুমার মামলা যিনি লড়ছেন, সেই সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানান, বিএড করা সত্ত্বেও যৌথ মেধা তালিকায় অগ্রাধিকার না পেয়ে রুমা মামলা করেছিলেন। কিন্তু অনিশ্চয়তা কাটেনি। তাঁর আক্ষেপ, “স্কুল সার্ভিস কমিশনকে হাইকোর্টে হলফনামা জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ওরা তা করেনি। ফলে মামলা বিলম্বিত হচ্ছে। এই মৃত্যু অনভিপ্রেত।” এসএসসি-র চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য অবশ্য দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, “চতুর্থ কাউন্সেলিং চলছে এখন। ভোটের পরে তৃতীয় দফা শুরু হবে। আমরা বারবার বলেছি, একটি পদও ফাঁকা পড়ে থাকবে না।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তাঁতশ্রমিক নিরাপদ দাসের ছোট মেয়ে রুমা। দাদা স্কুলশিক্ষক। দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বুধবার দুপুরে মা গিয়েছিলেন ডাক্তার দেখাতে। বাড়িতে রুমা ছাড়া কেউ ছিলেন না। বিকেলে নিরাপদবাবু কাজ থেকে ফিরে দেখেন, দরজা বন্ধ। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে দেখা যায়, নিথর দেহ ঝুলছে। পুলিশ সেটি নামিয়ে ময়না-তদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠায়।
রানাঘাট স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে রুমাদের বাড়িতে এ দিন দুপুরেও ভিড় করে ছিলেন আত্মীয়-পড়শিরা। তাঁরাই জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে রুমা স্টার পেয়েছিলেন। আপাতত কিছু ছোট ছেলেমেয়েকে পড়াতেন। আপ্রাণ চাকরির চেষ্টা করছিলেন। ২০১৩-য় এসএসসি-র যৌথ মেধা তালিকায় নাম ছিল তাঁর। কিন্তু পরে র্যাঙ্কে তাঁর পিছনের লোকজনকে চাকরি পেয়ে যেতে দেখে মুষড়ে পড়েন। ইতিমধ্যে উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগরের শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছেন রুমার দিদি অঞ্জনা বসু। তিনি অবশ্য বলেন, “বোন নানা পরীক্ষা দিচ্ছিল। আত্মহত্যা কেন করল, বুঝতে পারছি না।”
বস্তুত, রুমাদের এলাকাতেও এর মধ্যে রাজনীতির দড়ি টানাটানি শুরু হয়ে গিয়েছে। রানাঘাটের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক অলোককুমার দাসের অভিযোগ, “রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেই ওই তরুণী চাপে পড়ে গিয়েছিলেন।” অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে রানাঘাট ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তথা জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পাদক তাপস ঘোষের দাবি, “ওই পরিবারটি আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ। যত দূর জেনেছি, এর সঙ্গে চাকরি না হওয়ার সম্পর্ক নেই।”