ঘাগুরগাছিতে ঘুঘুর বাসা! আর সেই ঘুঘুর বাসাতেই মিলল রেলের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। পরের দিন পরীক্ষার সময় দেখা গেল, আগের রাতে আটক করা প্রশ্নের সঙ্গে মূল পরীক্ষার প্রশ্নের হুবহু মিল।
দুর্নীতি ঠেকাতে এ বার প্রার্থীদের ঠিকানায় অ্যাডমিট কার্ড না-পাঠিয়ে তা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে নিতে বলেছিল রেল। ইন্টারনেটের সুযোগ না-থাকায় গ্রামের বহু প্রার্থী পরীক্ষায় বসতেই পারেননি। প্রশ্ন উঠছে, দুর্নীতি ঠেকাতে হঠাৎ এমন বজ্র আঁটুনি সত্ত্বেও ফের প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গেল কোন ফস্কা গেরোর জন্য?
রবিবার ছিল রেল রিক্রুটমেন্ট সেল পরিচালিত গ্রুপ-ডি পদে কর্মী নিয়োগের শেষ দিনের পরীক্ষা। গোপন সূত্রে প্রশ্ন ফাঁসের খবর পেয়ে শনিবার গভীর রাতে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ভিজিল্যান্স অফিসারেরা নদিয়ার ঘাগুরগাছি গ্রামে একটি দোতলা বাড়িতে হানা দেন। তখনই বেরিয়ে পড়ে ঘুঘুর বাসা। হাতেনাতে ধরা পড়েন ২৪ জন পরীক্ষার্থী। ওই ঘরেই হাজার হাজার টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছিল রেলের গ্রুপ-ডি পদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। হাত ধরে লিখিয়েও দেওয়া হচ্ছিল উত্তর।
রবিবার পরীক্ষার পরে দেখা যায়, আগের রাতে আটক করা প্রশ্নের সঙ্গে পূর্ব রেলের গ্রুপ-ডি পদের পরীক্ষার প্রশ্ন মিলে গিয়েছে। পরপর পাঁচ রবিবার রেলের বিভিন্ন জোনে গ্রুপ-ডি পদে নিয়োগের পরীক্ষা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলেও শূন্য গ্রুপ-ডি পদে নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার্থী প্রায় ১৮ লক্ষ।
রেল সূত্রের খবর, শনিবার রাতেই রেলের ভিজিল্যান্স অফিসারেরা নদিয়া জেলা পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। গ্রেফতার করা হয় আট জনকে। ধৃতদের মধ্যে সঞ্জীব বিশ্বাস নামে ওই জালিয়াত চক্রের অন্যতম চাঁইও রয়েছে। সঞ্জীব ওই এলাকায় একটি বেসরকারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট চালান। তল্লাশিতে ঘটনাস্থলে একটি ডায়েরি পাওয়া গিয়েছে। কবে, কোথায়, কাকে, কত টাকা দিতে হবে বা দেওয়া হয়েছে, তা লেখা আছে তাতে।
রেলের মতো সরকারি সংস্থার পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হল কী ভাবে?
রেলকর্তারা এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র শুধু বলেন, “তদন্ত হচ্ছে। কী ভাবে এমন ঘটনা ঘটল, তদন্ত শেষ না-হলে তা জানা যাবে না।”
প্রশ্নপত্র তৈরির করার ক্ষেত্রে তো চূড়ান্ত গোপনতা বজায় রাখা হয় বলে দাবি করে রেল। তার পরেও কী ভাবে রেলকর্তাদের চোখ এড়িয়ে প্রশ্নপত্র এ ভাবে বাইরে বেরিয়ে আসে?
রেলকর্তারা এ ব্যাপারেও মুখ খুলতে রাজি নন। তবে রেলকর্মীদের একাংশের দাবি, রেলের রিক্রুটমেন্ট সেলের ভিতরেই রয়েছে ঘুঘুর বাসা। কোনও ভিজিল্যান্সই ওই দফতরের টিকি ছুঁতে পারে না। ছুঁতে গেলে রেলকর্তাদেরই একাংশ ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। এই অভিযোগের জবাবেও রেলকর্তারা বিশেষ কিছু বলতে চাননি। তাঁদের বক্তব্য, কোনও রেলকর্মী এর পিছনে থাকলে নিশ্চয়ই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রেলকর্তারা বারে বারেই এমন আশ্বাস দেন। তা সত্ত্বেও তাঁদের প্রায় প্রতিটি পরীক্ষাতেই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়। গত বছর ডিসেম্বরেও দক্ষিণ-পূর্ব রেলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছিল। তল্লাশির পরে সাঁতরাগাছিতে প্রশ্ন ফাঁসের বড় চক্র ধরা পড়ে। রেল জানায়, আটক প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্ন মিলে গিয়েছে। কিন্তু পরে রেলকর্তাদেরই একটা অংশ বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তৎপর হয়ে ওঠেন। হাত গুটিয়ে নেয় ভিজিল্যান্সও।
শুধু প্রশ্ন ফাঁস নয়, নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে বারবার নানা ধরনের গোলমাল হওয়ায় রেলের রিক্রুটমেন্ট সেলের কাজকর্ম সম্পর্কেই প্রশ্ন উঠছে। অভিযোগ উঠেছে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের এ বারের পরীক্ষা নিয়েও। রেল ওই পরীক্ষার জন্য ১০০ টাকা করে নিলেও প্রার্থীদের কাছে অ্যাডমিট কার্ড পাঠায়নি। ফলে বেশির ভাগ প্রার্থীই পরীক্ষায় বসতে পারেননি। উল্টে শেষ মুহূর্তে কম্পিউটার থেকে অ্যাডমিট কার্ড ডাউনলোড করার নির্দেশ দেওয়ায় বিতর্ক ও বিভ্রান্তি বেড়ে যায়। প্রার্থীরা ওই পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার দাবি তুলেছেন।
দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবিবাবু বলেন, “এই রবিবারেই পরীক্ষা শেষ হল। প্রার্থীদের ওই দাবির ব্যাপারে এখনও কোনও আলোচনা হয়নি।”