হাঁসখালিতে বাবুল সুপ্রিয় আর রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরাট ‘রোড-শো’র দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিলেন বিজেপি-র জেলা সভাপতি। কৃষ্ণগঞ্জের স্বর্ণখালিতে কুমার শানুর সভায় উপচে পড়া ভিড় দেখে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী দলের নেতা-কর্মীরা। বিধানসভা এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। গ্রামে গ্রামে ঘুরলে সর্বত্রই চোখে পড়ে দলের পতাকা, ফ্লেক্স, দেওয়াল লিখন। কোথাও আবার শাসক দলের থেকে বেশিই!
নাম ঘোষণার পর থেকেই কৃষ্ণগঞ্জের দলীয় কার্যালয়ে মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন বিজেপি প্রার্থী, কৃষিবিজ্ঞানী মানবেন্দ্রনাথ রায়। রাজ্য স্তরের একাধিক নেতাও সংগঠনকে মজবুত করে নির্বাচন পরিচালনার জন্য দিবারাত্র খাটছেন। আর এ সবের মধ্যে বিজেপি-র নেতা-কর্মীরা যেন ধরেই নিয়েছেন, এই উপনির্বাচনে তাঁদের জয় নিশ্চিত! দলের জেলা সভাপতি কল্যাণ নন্দী বলেও দিয়েছেন, “আমরা এ বার যে ভাবে এগোচ্ছি, তাতে জয় ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না!”
কিন্তু রূপা-শানুদের দেখার ভিড় শেষ পর্যন্ত ইভিএম পর্যন্ত পৌঁছবে কি না, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরছে কৃষ্ণগঞ্জে। উপনির্বাচন ঘোষণার আগে থেকেই এলাকায় বিজেপি সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল ঠিকই। কিন্তু সাংগঠনিক জোর এখনও ভোট-যুদ্ধে তৃণমূলের সঙ্গে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দেওয়ার মতো জায়গায় পৌঁছেছে কি না, তা নিয়ে গেরুয়া শিবিরের অন্দরেই দ্বিমত আছে। গত লোকসভা ভোটে এই বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি ভোট পেয়েছিল ২৯ হাজার। সেখানে শাসক দল পেয়েছিল প্রায় ৯৭ হাজার ভোট। সিপিএম পেয়েছিল প্রায় ৬১ হাজার ভোট। আর কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৬ হাজার। তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপি-র ভোটের ব্যবধান ছিল ৬৮ হাজার। এই অঙ্কের হিসাবেই তৃণমূল নেতৃত্ব আত্মবিশ্বাসী, প্রচারে যা-ই হোক, ভোটে বিজেপি বাধা হবে না!
বস্তুত, তৃণমূল নেতারা এখনও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে সিপিএমকেই এগিয়ে রাখছেন! শাসক দলের নদিয়া জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তের কথায়, “বিজেপি দিবাস্বপ্ন দেখছে! এর আগের ভোটগুলোর কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। মাত্র ৮ মাস আগের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি আমাদের থেকে প্রায় ৬৮ হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিল। এই ক’মাসে এই কেন্দ্রে কী এমন ঘটল, যার জন্য বিজেপি এই বিরাট ব্যবধান ঘোচাতে পারবে? সিপিএম, বিজেপির আর কংগ্রেসের ভোট এক করলেও তারা আমাদের থেকে পিছিয়ে!” তাঁর আরও দাবি, “সিপিএম আর কংগ্রেস যদি শূন্য ভোটও পায়, আর তাদের সব ভোট যদি বিজেপি পায়, তা হলেও ওরা জিতবে না!”
বিজেপি আবার ঠিক সেই অঙ্কেই তৃণমূলের সঙ্গে ব্যবধান মুছে ফেলার স্বপ্ন দেখছে! সিদ্ধার্থনাথ বা রাহুল সিংহদের যুক্তি, সারদা-কাণ্ডে বিপর্যস্ত তৃণমূলের নানা অপকর্মে রাজ্যের সর্বত্রই মানুষ বিরক্ত। সিপিএম বা কংগ্রেসের পক্ষে এখন তৃণমূলের বিকল্প হয়ে ওঠা সম্ভব নয়, এই কথাও মানুষ বুঝে গিয়েছেন। তাই কংগ্রেস এবং বিশেষত, বামেদের ঝুলি থেকে ভোট ভেঙে গেরুয়া বাক্সে আসবে বলে হিসেব কষছেন তাঁরা। দলের জেলা সভাপতি কল্যাণবাবুও বলছেন, “বাম কর্মী-সমর্থকেরা বুঝে গিয়েছেন, এ বার আর সিপিএম জিততে পারবে না। আবার তৃণমূলের অত্যাচারের হাত থেকে তাঁদের বাঁচতে হবে। তাই তাঁরা এ বার আমাদের সঙ্গে থাকবেন।”
সিপিএমের চ্যালেঞ্জটা ঠিক এখানেই। তাদের লড়াই নিজেদের ভোট ধরে রাখার। এই মুহূর্তে কৃষ্ণগঞ্জ এলাকায় সিপিএমের সংগঠন তেমন শক্তিশালী নয়। প্রচারেও তেমন জোর নেই। কিন্তু তাই বলে তাদের ভোট পুরোপুরি উবে গিয়ে বিজেপি-র জয়ের রাস্তা খুলে দেবে, এতটাও মেনে নিতে পারছেন না জেলা রাজনীতির অনেকেই! সিপিএম এ বার প্রচারের আড়ম্বরে না গিয়ে নীরবে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি যোগাযোগ করছে। দলের জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলছেন, “আমাদের লক্ষ্য, নিজেদের ভোট ধরে রাখা। আর পারলে নানা জায়গায় নানা কারণে চলে যাওয়া, ভোট যতটা সম্ভব ফিরিয়ে আনা।”
সেই কাজ যে খুব সহজ নয়, বিলক্ষণ জানেন সিপিএম নেতারা। তবে মাসকয়েক আগে এই এলাকার ঘুঘড়াগাছিতে জমির দখল ঠেকাতে গিয়ে তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতীদের গুলিতে অপর্ণা বাগ খুন এবং আরও তিন জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিল সিপিএম-ই। ফলে, আশপাশের এলাকায় তাঁরা এর সুফল পাবেন, আশাবাদী সিপিএম নেতারা।
প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখার লড়াইয়ে আছে কংগ্রেসও। দীর্ঘ দিন পরে এই এলাকায় অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বে ভোটের ময়দানে দলীয় প্রতীক নিয়ে লড়াই করার সুযোগ পেয়েছেন কংগ্রেস কর্মীরা! সীমিত সাংগঠনিক শক্তি নিয়েই এলাকায় রীতিমতো চষে বেড়াচ্ছেন অধীর। ঘাঁটি গেড়ে আছেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতা এবং বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তীও। দলের জেলা সভাপতি অসীম সাহার বক্তব্য, “গত লোকসভা ভোটে আমাদের প্রার্থী থাকলেও সুনির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা ছিল না। সেই অর্থে ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটের পরে আমাদের কর্মীরা দলের পতাকা নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করার সুযোগ পেয়েছেন। তার একটা ফল তো আমরা পাবই।” ঘরোয়া আলাপচারিতায় কংগ্রেস নেতারা মানছেন, লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ৬ হাজার ভোট সামান্য বাড়াতে পারলেও তো লাভ!
সাধারণ পাটিগণিত বলে, বিরোধীদের মধ্যে ভোট যত ভাগাভাগি হয়, শাসক দলের তত সুবিধা। কিন্তু রাজ্য রাজনীতি এখন সহজ পাটিগণিতে চলার জায়গায় নেই! তৃণমূলও তাই খুব স্বস্তিতে নেই। সারদা-কাণ্ডের অস্বস্তি তো বটেই। দলের সব অংশ ভোটের ময়দানে আগের মতো ‘সক্রিয়’ থাকবে কি না, আশঙ্কা আছে দলের অন্দরেই! তার উপরে আছে প্রার্থী-কাঁটা! দলের জেলা সভাপতি গৌরীবাবুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সত্যজিৎ বিশ্বাসকে প্রার্থী করায় তৃণমূলের একাংশ ক্ষুব্ধ। প্রার্থী হওয়ার প্রত্যাশা যাঁদের ছিল, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হয় বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। কেউ প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছেন। আবার কেউ নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে গিয়েছেন। কেউ তলায় তলায় যোগাযোগ করছেন বিজেপি-র সঙ্গে। তৃণমূলের ভিতরেই এই ‘চোরাস্রোত’ পায়ের তলার মাটি কতটা ধসিয়ে দিতে পারে, সে দিকে তাকিয়ে আছে বিরোধীরা।
এই চোরাস্রোতের কথা জানেন বলেই বিজেপি নেতারা নাগাড়ে আউড়ে চলেছেন তৃণমূলে ভাঙনের সম্ভাবনার কথা। আর বিরোধী ভোট ভাগাভাগি আটকাতে তাঁরা বেশি করে নজর দিয়েছেন বাম ভোটব্যাঙ্কের দিকে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে রাজ্যে বিজেপি-র পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ বুথে বুথে গিয়ে যখনই দলীয় কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, বারবার জিজ্ঞাসা করেছেন তাঁদের দলে সিপিএম থেকে কেমন লোক আসছে? বুথ কমিটিগুলিতে সিপিএমের লোক কত আছে? সিপিএমের হয়ে কারা পোস্টার মারছে? অর্থাৎ তাঁর কথায় বারবার ফুটে উঠেছে, এই মুহূর্তে সিপিএমের সাংগঠনিক অবস্থা বোঝার চেষ্টাই করেছেন তাঁরা। বিজেপি-র এক জেলা নেতার কথায়, “জিততে হলে আমাদের সিপিএমের ভোটের উপরে ভরসা করতে হবে। সিপিএম কতটা ভাঙছে, তার উপরে আমাদের জয়ের অনেকটাই নির্ভর করছে। আমাদের হিসেব অনুযায়ী, সিপিএম থেকে অন্তত ৩৫-৪০ হাজার ভোট টেনে আনতেই হবে। আর তৃণমূল থেকে অন্তত ২০ হাজার।”
কঠিন অঙ্ক! বিজেপি নেতাদের আত্মবিশ্বাস বলছে, সম্ভব! সত্যিই সম্ভব কি না, বলবে কৃষ্ণগঞ্জ!