ছ’মাস পরে আরও এক বার মূল্যায়ন। মাপকাঠি বদলাল না এতটুকু!
প্রকৃত উন্নয়নের বদলে কাজের জন্য কোন দফতর কত টাকা মঞ্জুর করেছে, স্রেফ তার ভিত্তিতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের সেরে ফেললেন সরকারের কাজের পর্যালোচনা। কোনও দফতরকে সবুজ, কাউকে হলুদ, কাউকে দেখালেন লালকার্ড। কিন্তু শুক্রবারের এই বৈঠকে, পরিকল্পনা খাতের ওই টাকায় কাজ কতটা হল, বৈঠকে তার কোনও পর্যালোচনাই হল না।
বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র দাবি করেন, চলতি অর্থবর্ষের প্রথম দিন ১ এপ্রিল থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কয়েকটি কেন্দ্রীয় প্রকল্প এবং রাজ্য পরিকল্পনা খাতে দফতরগুলিকে মোট ২০ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, যা গত আর্থিক বছরের এই সময়ের তুলনায় ৬৩.৫৫% বেশি। কিন্তু তার মধ্যে উন্নয়নের কাজে খরচ হয়েছে কতটা? এর কোনও জবাব দেননি অর্থমন্ত্রী। প্রশ্নটি শুনেই সোজা গাড়িতে উঠে রওনা দেন তিনি।
সরকারি কর্তাদের একাংশ খোলাখুলিই বলছেন, দফতরগুলির জন্য বরাদ্দ টাকায় কতটা উন্নয়নের কাজ হল, এ ধরনের বৈঠকে তার প্রকৃত পর্যালোচনা হওয়াটাই কাম্য। কিন্তু বাস্তবে সেটাই হচ্ছে না। অর্থ দফতরও টাকা ছাড়ার হিসেব পেশ করেই তাদের দায়িত্ব সারছে। কর্তাদের কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, অতীতে টাকা ছাড়াই হত না। এখন অন্তত মুখ্যমন্ত্রীর চাপে দফতরগুলি টাকা জেলাস্তরে নামিয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু খরচের বহর কেমন?
অর্থমন্ত্রীর দাবি, সেই হিসেব এখনও তৈরি হয়নি। যদিও তাঁর দফতর সূত্রের খবর, এ বছর যে টাকা ‘রিলিজ’ করা হয়েছে, তার উল্লেখযোগ্য খরচ হয়নি। আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসে যে পর্যালোচনা হবে, তখন টাকা খরচের প্রকৃত ছবিটা জানা যেতে পারে। বৈঠকে বাজেটের টাকা খরচের হিসেব দেখে যে রিপোর্ট কার্ড তৈরি হয়েছে, তাতে ভেজাল রয়েছে বলেও মনে করছেন অনেক সরকারি কর্তা। কী রকম? রাজ্য অর্থ দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, বাজেটের পরিকল্পনা খাতে বিভিন্ন দফতরের জন্য যা বরাদ্দ থাকে, সেই টাকা অর্থ দফতর থেকে সংশ্লিষ্ট দফতরে ব্যাঙ্ক বা ট্রেজারি মারফত চলে যাওয়া মানেই খাতায়-কলমে তা খরচ হয়ে যাওয়া। কিন্তু দফতরগুলি বাস্তবে সেই খরচ করতে পারল কি না, সেই টাকায় প্রকৃত উন্নয়নের কাজ হল কি না, তার নজরদারি হচ্ছে না।
প্রশ্ন হল, দফতরগুলি হাতে টাকা পেয়ে কী করছে? উদাহরণ দিয়ে একটি দফতরের সচিব বলেন, “অর্থ দফতর থেকে পাওয়া টাকা অনেক ক্ষেত্রেই দফতরের কোনও-না-কোনও পার্সোনাল লেজার (পিএল) অ্যাকাউন্টে ফেলে রাখা হচ্ছে। আসলে কিন্তু তা খরচ হচ্ছে না।”
বৈঠকে উপস্থিত অফিসারদের একাংশ জানাচ্ছেন, পর্যালোচনা বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী এ বার কোনও মন্ত্রী বা অফিসারকে বকাঝকা করেননি। তবে পরিবহণ নিয়ে আলোচনার সময় দফতরের মন্ত্রী মদন মিত্র হাজির থাকলেও তাঁকে এড়িয়ে তিনি কথা বলেন সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পাশাপাশি, বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দফতর নিয়েও কোনও আলোচনাই করেননি মুখ্যমন্ত্রী। অনেকের ধারণা, সারদা-কাণ্ডে ওই দুই মন্ত্রীর নাম জড়ানোয় সচেতন ভাবেই তাঁদের এড়িয়ে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
গত ২৮ মে চলতি আর্থিক বছরের প্রথম পর্যালোচনা বৈঠকে কাজ করতে না পারায় বেশ কয়েক জন মন্ত্রীকে ধমক দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই পথে না হেঁটে তিনি এ দিন বলেন, “যাদের কাজকর্ম এ ক’মাসে তেমন ভাবে এগোয়নি, তাদের আরও ভাল ভাবে কাজ করতে হবে।” প্রয়োজনে পিছিয়ে থাকা দফতরগুলি নিয়ে তিনি আলাদা ভাবে বসবেন বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী। আবার যে সব দফতর বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য টাকা ‘রিলিজ’-এর ক্ষেত্রে তৎপরতা দেখিয়েছে, তাদেরও কিছু কাজ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
যেমন, পঞ্চায়েত দফতরের অধীন প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়ক যোজনা এবং ১০০ দিনের কাজ নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হননি মমতা। বৈঠকে তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম-সড়ক যোজনায় লক্ষ্যমাত্রার ১০% মাত্র কাজ হয়েছে। কেন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি, মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। ফলে টাউন হলের বৈঠকের পর জেলাশাসকদের নিয়ে আলাদা করে বৈঠক করেন মুখ্যসচিব। সেখানে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম-সড়ক যোজনার পাশাপাশি ১০০ দিনের কাজে মজুরির টাকা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে দেওয়ার ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় যে সমস্যা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকদের সঙ্গে তা নিয়েও কথা বলেন মুখ্যসচিব।
রাজ্যের রেশন ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। কেন এখনও ডিজিটাল রেশন কার্ড তৈরি করা গেল না, সেই প্রশ্ন তুলে খাদ্যমন্ত্রী ও দফতরের সচিবকে আরও তৎপর হতে বলেন তিনি। আবার, পর্যটন দফতরের দিঘা-মন্দারমনি-সহ বেশ কয়েকটি জায়গায় প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে গড়িমসি নিয়েও তিনি যে অখুশি, তা জানিয়ে দেন মমতা। তাঁর নিজেরই হাতে থাকা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের পাট্টা বিলির কাজ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মুখ্যমন্ত্রী।
তবে তাঁর সিঙ্গাপুর সফর, রাজ্যে শিল্পায়ন নিয়ে কার্যত সময় ব্যয় করেননি মুখ্যমন্ত্রী। শুধু বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনের কাছে অন্ডালের বিমাননগরীর কাজের অগ্রগতির কথা জানতে চান। এখানেই সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্ট ইন্টারন্যাশনাল বিনিয়োগ করেছে। প্রায় দু’ঘণ্টার বৈঠকে রাজ্যে শিল্পায়নের খরা পরিস্থিতি কী ভাবে কাটানো যায়, কেন গত তিন বছরে বড় বিনিয়োগ আসেনি রাজ্যে, কেন বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে থাকা শিল্প-পার্কগুলিতে এখন ফাঁকা জমি পড়ে তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কেন একটিও শব্দ খরচ করলেন না, তা নিয়ে বিস্মিত অনেক আমলাই।
নতুন সরকারের আমলে শিল্প নেই বলে যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না, তেমনই জেলাগুলিতে একাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের অন্যতম বৃহৎ শিল্প ডানলপ খোলার ব্যাপারে সরকারের তেমন কোনও উদ্যোগ নেই। বন্ধ হয়ে গিয়েছে হিন্দমোটরের মতো কারখানাও। প্রায় মুখ থুবড়ে পড়া রাজ্যের এই শিল্প পরিস্থিতি মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী কোনও দিশা দেবেন বলে অনেকেই মনে করেছিলেন। সেই পথে না গিয়ে শিল্প দফতরকে ভালো কাজের জন্য মুখ্যমন্ত্রী ‘গ্রিন-কার্ড’ দেওয়ায় পর্যালোচনা বৈঠকের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।