যুগ বদলেছে। বদলেছে ভাবনা-চিন্তার ধরন। বদলাচ্ছে যোগাযোগের পদ্ধতি। পাল্টে যাওয়া জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল রেখেই দলের ভাবনা-চিন্তায় পরিবর্তন আনার পক্ষে সওয়াল করল কলকাতার সিপিএম। কিন্তু তাতেও থেকে গেল প্রশ্ন!
রাজনীতির হরেক রকম বিষয়ে কলকাতা শহরে মিটিং-মিছিল লেগেই থাকে। কিন্তু প্রথাগত পদ্ধতিতে সভা-সমাবেশে কঠিন ভাষায় দীর্ঘ বক্তৃতা করে এখন যে আর মানুষের মন পাওয়া সহজ নয়, এ বার মেনে নেওয়া হয়েছে কলকাতা সিপিএমের রাজনৈতিক দলিলে। পরিবর্তিত সময়ে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে মাঠে-ময়দানে কর্মসূচির পাশাপাশি টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে উপযুক্ত ভাবে ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করেছেন কলকাতার সিপিএম নেতৃত্ব। এ রাজ্যে তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় স্তরে বিজেপি-ও নতুন যুগের চাহিদা বুঝে প্রচারের আঙ্গিক বদলেছে। দেরিতে হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় হয়েছে বামেরাও। এ বার তাকেই আরও নির্দিষ্ট নীতি হিসাবে মেনে চলার কথা উঠে আসতে শুরু করল সিপিএমের অন্দরে।
তবে দলের অন্দরেই প্রশ্ন রয়েছে, শুধু প্রচারের ধরন বদলালেই কি মানুষের মন পাওয়া সম্ভব? সভা-সমাবেশ হোক, টিভি-বিতর্ক হোক বা সোশ্যাল মিডিয়া দলের ‘মুখ’ হিসাবে যাঁরা সামনে যাবেন, তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে কাজের কাজ হবে কি? ‘মুখ’ ঠিক থাকলে সভা-সমাবেশ করে বা রেডিওতে বক্তৃতা করেও যে বিপুল সাড়া পাওয়া যায়, হালফিল তার উদাহরণ তো নরেন্দ্র মোদী! আলাদা আলাদা জনসমষ্টির জন্য নির্দিষ্ট বিষয়ে ধারালো বক্তৃতাই মোদীর দস্তুর। কলকাতা জেলা সিপিএমের এক নেতা অবশ্য বলছেন, “মুখ বদলের প্রক্রিয়া তো বিভিন্ন স্তরে সাংগঠনিক ভাবে চলছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে এবং পরে মোদী বক্তৃতাতেই বাজার মাত করে যাচ্ছেন, এটাও সত্যি! আমরা বলতে চাইছি, সভা-সমাবেশে বক্তৃতা আরও যুগোপযোগী হোক। অন্যান্য মাধ্যমও বেশি করে ব্যবহৃত হোক।”
প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে কলকাতা সিপিএমের ২৩ তম জেলা সম্মেলনে পেশ-হওয়া রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক খসড়া প্রতিবেদনে খোলাখুলিই মেনে নেওয়া হয়েছে: ‘আজকের জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল রেখে আমাদের প্রচারকে হতে হবে সংক্ষিপ্ত ও তীক্ষ্ম। দীর্ঘ দাবিসনদ এখন মানুষকে আকর্ষণ করতে পারছে না’। বলা হয়েছে, ‘তরুণ প্রজন্মকে আমরা আকর্ষণ করতে পারছি না।.. অতীতে প্রত্যক্ষ গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। কিন্তু বর্তমানে সে অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে টেলিভিশন দেখে’। সেই জন্যই কলকাতা জেলা নেতৃত্বের সুপারিশ: ‘রাজ্য কমিটির কাছে আমাদের অনুরোধ, টেলিভিশনে রাজনৈতিক বিতর্কগুলিতে আমাদের অবস্থান যাঁরা দৃঢ়তার সঙ্গে হাজির করতে পারেন, সে রকম প্রশিক্ষিত কমরেডদের পাঠানো হোক’। তবে দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব বাড়লেও সার্বিক বিচারে এখনও তা সীমিত। হাটে-বাজারে, পাড়ায় পাড়ায় পথসভা, ছোট ছোট জনসংযোগ এবং পথে নেমে আন্দোলনের এখনও কোনও বিকল্প নেই। তবে তার মধ্যেই অন্যান্য মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে।” পাশাপাশিই দলের একাংশ বলছে, টিভি বা ওয়েব’কে যখন এক দিকে বেশি ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে, দলের মধ্যেই আবার যাঁরা ওই সব কাজে বেশি সক্রিয়, তাঁদের নিয়ে কটাক্ষের রেওয়াজও অব্যাহত!
ওই প্রতিবেদনেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে, ঠিক এই মুহূর্তে দু’রকম প্রচারের মোকাবিলা বামেদের করতে হচ্ছে। প্রথমত, তৃণমূল আমলে যা ঘটছে, সবই নাকি ৩৪ বছরের বাম শাসনের অনুকরণ! আর দ্বিতীয়ত, বামপন্থীরা হীনবল। তাই তৃণমূলের মোকাবিলা করতে পারে একমাত্র বিজেপি। এই দুই প্রচারের সঙ্গে এঁটে উঠতে গেলে নিজেদের প্রচারের পদ্ধতি যে বদলানো দরকার, বলা হয়েছে সে কথাই। সওয়াল করা হয়েছে মানসিক গঠন (মাইন্ডসেট) পরিবর্তনের পক্ষে।
দল হিসেবে তৃণমূলের যোগাযোগ পদ্ধতি এখন যথেষ্টই আধুনিক। মোদীর দলেরও তা-ই। বিজেপি-র এক রাজ্য নেতার বক্তব্য, “সময়ের প্রয়োজনের কথা ভেবেই আমরা কলকাতার পুরভোটেও ওয়ার্ডভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট খুলতে চাইছি।” টিভি এবং ওয়েব-মাধ্যম ধরে সিপিএমও হাঁটতে চাইছে একই পথে।
‘মাইন্ডসেট’ বদলানোর যুক্তি দেওয়ার পাশাপাশিই কলকাতার রাজনৈতিক প্রতিবেদনে মেনে নেওয়া হয়েছে ভাবনাচিন্তা না বদলানোর কথাও! দলের বিপর্যয়ের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘সরকার বা পুরসভা পরিচালনার সময় মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে আমাদের কাছে আসত। মানুষের কাছে তার প্রয়োজনে আমরা যাইনি। কমিউনিস্ট কর্মী হয়েও এই ভুল আমরা করেছি’। ওখানেই স্বীকারোক্তি, ‘প্রতিদিনকার সাংগঠনিক কাজে ৩৪ বছরের মাইন্ডসেট আমরা এখনও পরিবর্তন করতে পারিনি’। ভবিষ্যতে গণভিত্তি ফিরে পেতে গেলে এই ভাবনার ধরন পরিবর্তনের কথাই আসছে সম্মেলনে।