শিল্প সম্মেলন উপলক্ষে নিউ টাউনের ইকো পার্কের ভোজসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। —নিজস্ব চিত্র
মঙ্গলবার কলকাতায় পা রেখেছেন এক মার্কিন দৈনিকের সাংবাদিক। বিশ্ব জুড়ে বাণিজ্যিক দৈনিকের বাইবেল বলে গণ্য করা হয় তাঁর কাগজকে। আজ, বুধবার থেকে শুরু হতে চলা ‘গ্লোবাল বিজনেস সামিট’-ই নিশ্চয় তাঁর গন্তব্য? মোটেই না। মুখ্যমন্ত্রীর ছবি-সহ তাঁর সাধের ‘বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন’-এর বিজ্ঞাপনে গোটা শহর ছয়লাপ হয়ে গেলেও এহেন শিল্প বৈঠকের কথা জানাই নেই বারাক ওবামার দেশের সাংবাদিকের! তিনি এসেছেন জাপানি পর্যটককে ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্ট করতে।
সল্টলেক স্টেডিয়াম চত্বরে বসা ‘আন্তর্জাতিক শিল্প সম্মেলন’ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যতই ঢাকঢোল পেটাক, সেটা কতটা ‘আন্তর্জাতিক’ তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, প্রশ্ন রয়েছে এটা আদৌ শিল্প সম্মেলন পদবাচ্য কি না, তা নিয়েও। শিল্প মহলের কোন কোন প্রতিনিধি, কোন কোন দেশের অতিথি-অভ্যাগত সম্মেলনে যোগ দেবেন, তা নিয়ে ২৪ ঘণ্টা আগেও মুখে কুলুপ উদ্যোক্তাদের। সম্মেলনের ওয়েবসাইটে যোগাযোগের যে নম্বর দেওয়া রয়েছে, মঙ্গলবার বিকেলে সেখানে বহু বার ফোন করেও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। সরকারি মহল বলছে, এ রাজ্যের শিল্পপতিদের অনেকেই সম্মেলনে আসবেন। শিল্পমন্ত্রীর কাকুতি-মিনতি এড়াতে না-পেরে দেশের শিল্পপতিদেরও কেউ কেউ হয়তো সম্মেলনে পা রাখবেন। কিন্তু শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতিরা দল বেঁধে আসবেন, এমন আশা ক্ষীণ। আর ভিন্ দেশের বড় মাপের শিল্পকর্তাদের তো কথাই নেই।
রাজ্য সরকারের মৌনতাকে কটাক্ষ করে বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন বলেছেন, “বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনের আগের দিন পর্যন্ত জানা যাচ্ছে না, কারা আসবেন। মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গাপুর সফরের পরে যেমন কোনও শিল্প আসেনি, এতেও তেমনই গরিব রাজ্যের কিছু অর্থ নষ্ট হওয়া ছাড়া আর কিছু হবে না।”
এর উল্টো দিকে ১১ জানুয়ারি থেকে নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যে শুরু হচ্ছে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ শিল্প সম্মেলন। পশ্চিমবঙ্গের মতো গালভরা ‘গ্লোবাল’ তকমা তার নেই। কিন্তু দেশ-বিদেশের অতিথির ঢল নামবে সেখানে। সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, আন্তর্জাতিক উড়ানের সংখ্যা দেখে যেমন একটি রাজ্যের শিল্পোন্নয়নের গতিমুখ বোঝা যায়, তেমনই বিদেশি অভ্যাগতের সংখ্যার উপরই নির্ভর করে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সাফল্য। তাঁদের বেশির ভাগই এসে নামবেন দিল্লি অথবা মুম্বইয়ে। এই অভ্যাগতদের সংখ্যা এতটাই বেশি যে, সেখান থেকে তাঁদের আমদাবাদে আনতে বিশেষ উড়ান চালাতে হচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া, জেট, ইন্ডিগোকে।
এর পাশাপাশি শিল্পপতিদের নিজস্ব অন্তত ১২০টি ছোট বিজনেস জেট শিল্প সম্মেলন চলাকালীন আমদাবাদ বিমানবন্দর ছোঁবে বলে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত খবর। গুজরাত বিমান পরিবহণ দফতরের কর্তা যশপাল রাঠৌর রাতে জানান, এই সব ছোট বিমান শিল্পপতিদের আমদাবাদে নামিয়ে দিয়ে বডোদরা, উদয়পুর-সহ আশপাশের অন্য বিমানবন্দরে চলে যাবে। এত বিমান দাঁড়ানোর জায়গা আমদাবাদে নেই।
অন্য দিকে, বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে যোগ দিতে একটাও বিজনেস জেট দমদমে আসছে, এমন খবর এখনও পর্যন্ত মেলেনি। কোনও বাড়তি উড়ান চালানোর কথাও নেই।
আমদাবাদে বাড়তি উড়ান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কেন? এয়ার ইন্ডিয়া সূত্রে বলা হচ্ছে, মাস তিনেক আগে থেকেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমদাবাদে আসার ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয়। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রশ্ন আসে, দিল্লি থেকে আমদাবাদ কত ক্ষণে যাওয়া যাবে? বিমানের ভাড়া কত? দিল্লি ছাড়া অন্য কোন শহর থেকে আমদাবাদের কী কী উড়ান রয়েছে? এখন প্রতিদিন দিল্লি থেকে আমদাবাদ তিনটি করে উড়ান চালায় এয়ার ইন্ডিয়া। সংস্থার কর্তারা বুঝতে পারেন, গুজরাতে শিল্প-সম্মেলন চলাকালীন অতিরিক্ত উড়ান চালালে আখেরে তাঁদের লাভ হবে। তাই ১০, ১১ এবং ১৪ জানুয়ারি এই তিন দিন দিল্লি-আমদাবাদ রুটে একটি করে অতিরিক্ত উড়ান চালানো হবে বলে ঠিক হয়েছে। ১২২ আসনের সেই বিমানে সাধারণ শ্রেণি ছাড়াও থাকবে বিজনেস শ্রেণি।
অতিরিক্ত উড়ান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরও দুই বিমানসংস্থা, জেট এবং ইন্ডিগো। আমদাবাদ বিমানবন্দরের অধিকর্তা আর কে সিংহ মঙ্গলবার ফোনে জানান, ইন্ডিগো ৪ জানুয়ারি থেকেই প্রতিদিন দু’টি করে অতিরিক্ত উড়ান চালাতে শুরু করে দিয়েছে। এই দু’টি উড়ানই মুম্বই থেকে আমদাবাদ হয়ে দিল্লি যাবে। আবার ওই পথেই ফিরে আসবে। জেট বিমানসংস্থা ৮ এবং ১১ জানুয়ারি মুম্বই-আমদাবাদ-মুম্বই রুটে অতিরিক্ত উড়ান চালানোর কথা ঘোষণা করেছে। ৭ ও ১০ তারিখ দিল্লি-আমদাবাদ-দিল্লি রুটেও অতিরিক্ত উড়ান চালাবে জেট।
তা হলে কলকাতা নয় কেন? তিন বিমানসংস্থার কর্তাদের বক্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-বৈঠকে যোগ দিতে আসছেন, এমন কোনও যাত্রীর কথা আমরা শুনিনি। আমদাবাদের মতো কলকাতায় আসার জন্য হুড়োহুড়িও নজরে পড়েনি। গত নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে ছুটিছাটার কারণে এমনিতেই টিকিটের চাহিদা বেড়েছে। জানুয়ারির শিল্প সম্মেলনের জন্য তার কোনও তারতম্য ঘটেনি।”
অভ্যাগতদের স্বাগত জানাতে আমদাবাদ বিমানবন্দরে এখন থেকেই আলাদা অভ্যর্থনা ডেস্ক বানানো হয়েছে। সেখানে সর্বক্ষণ থাকছেন গুজরাত শিল্প দফতরের অফিসারেরা। আর কে সিংহের কথায়, “এলাহি কাণ্ড চলছে। রাজ্য সরকারের প্রোটোকল অফিসারেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দেশ-বিদেশ থেকে আসা অভ্যাগতদের জন্য বিমানবন্দরের বাইরে বড় বড় বাস ও গাড়ি রাখা থাকছে।” যে অতিথিরা বিমান থেকে নেমে সরাসরি শিল্প বৈঠকে যোগ দিতে যাবেন, তাঁদের জন্য মাঝপথে একটি হোটেলে ‘ফ্রেশ’ হওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
আর কলকাতা?
বিমানবন্দর সূত্রের খবর, এক জন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কয়েক জন সদ্যনিযুক্ত মহিলা কনস্টেবল সাদা পোশাকে রয়েছেন অভ্যর্থনার জন্য। বাইরে বাস-টাস নয়, চার চাকার গুটিকতক গাড়ি। কারণ, মঙ্গলবার যে ক’জন অভ্যাগত আসবেন বলে সরকারি তালিকা বিমানবন্দরে পৌঁছেছে, তাঁদের সংখ্যা মাত্র ১৩। বুধবারের তালিকা এখনও আসেনি!