পদে রদবদলের ইঙ্গিত ছিলই। সেই ইঙ্গিতকেই আরও জোরালো করে তুলে এ বার দলের রাজ্য কমিটি থেকেও অব্যাহতি চেয়ে নিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। দলের রাজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে বিমানবাবু আসলে প্রশ্ন তুলে দিলেন সিপিএমে ‘বৃদ্ধতন্ত্র’ নিয়েই! নিজের উদাহরণ দিয়েই সওয়াল করলেন তরুণ রক্ত আমদানির জন্য।
এ বারের রাজ্য সম্মেলন থেকেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক পদ থেকে বিমানবাবু বিদায় নেবেন, এই প্রক্রিয়া সিপিএমের অন্দরে ইতিমধ্যেই চালু ছিল। এর আগে কয়েকটি জেলা সম্মেলনে গিয়েও বিমানবাবু প্রবীণদের পদ আঁকড়ে থেকে না যাওয়ার আর্জি জানিয়ে এসেছেন। তার পরেও চলতি রাজ্য সম্মেলনে প্রশ্ন উঠেছে নেতৃত্বে তারুণ্যের অভাব নিয়ে। একের পর এক প্রতিনিধি প্রশ্ন তুলেছেন, নির্দিষ্ট বয়সের পরে নেতারা দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন না কেন? নতুন মুখ তুলে না আনলে মানুষের কাছে হারানো বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পাওয়া যে দুরাশা, তা নিয়েও সরব হয়েছে সম্মেলন। এ সবের প্রেক্ষিতেই সম্মেলনের তৃতীয় দিন, বুধবার রাতে রাজনৈতিক প্রতিবেদনের উপরে জবাবি ভাষণ দিতে গিয়ে সরাসরি রাজ্য কমিটি থেকে অব্যাহতি চেয়ে নিয়েছেন বিমানবাবু। এবং কৌশলে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো কারও কারও নেতৃত্বে থেকে যাওয়া নিয়েও!
সিপিএম সূত্রের খবর, জবাবি বক্তৃতায় এ দিন ‘তরুণ কমরেড’দের এগিয়ে আসার উপরেই গুরুত্ব দিয়েছেন বিমানবাবু। সেই সূত্রেই রাজ্য সম্পাদক বলেছেন, তাঁর জন্ম ১৯৪০ সালে। এখন ৭৫ চলছে। যে কোনও দিন ‘পট’ করে ৭৬ হবে! এই বয়সের লোককে কমিটিতে আর রাখা উচিত কি না, রাজ্য কমিটি বিবেচনা করে দেখুক। নেহাতই কথার কথা নয়, বিবেচনা যে আন্তরিক ভাবেই করতে হবে, সেই আবেদনও সম্মেলনের মঞ্চ থেকেই বিমানবাবু করেছেন। তিনি বলেন, “কোনও ডন কিহোতে এসে হঠাৎ পার্টির অবস্থার উন্নতি করে দেবে না! সংগঠন জরুরি।” পাশাপাশিই বলেছেন, ৭০-৭৫ বছর বয়সী লোকজন যদি কমিটিতে থেকে যাবেন, তা হলে নতুনদের জায়গা হবে কী ভাবে!
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুও ৭০ ছাড়িয়েছেন। দলে আরও অনেকের মতো বুদ্ধবাবুও রাজ্য সম্পাদক পদে পরিবর্তনে আগ্রহী। দলের একাংশের মতে, নিজের আসন্ন বিদায় অনিবার্য করে তুলে বিমানবাবু কৌশলে জড়িয়ে নিলেন বুদ্ধবাবুকেও! সম্মেলনের শেষ দিনে নবগঠিত রাজ্য কমিটি সত্যিই যদি বিমানবাবুকে বাদ দেয়, তখন বুদ্ধবাবুকে রেখে দিলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে। সিপিএমের এক রাজ্য নেতার কথায়, “বিমানদা যে ভাবে বয়সের কারণে সরে যাওয়ার কথা বলেছেন, তার পরে সেটা বিবেচনা না করা মুশকিল! আবার শুধু এক জনকে ওই কারণে বাদ দেওয়াও সমস্যা।” বুদ্ধবাবু অবশ্য আগেই রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী-সহ সব ধরনের কমিটি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন। কিন্তু দলের পলিটব্যুরো সদস্যেরা তাঁকে রাজ্য কমিটিতে রেখে দেওয়ার জন্য লড়াই জারি রেখেছিলেন। বিমানবাবুর এ দিনের আর্জির পরে সেই লড়াই এ বার কঠিন হয়ে গেল!
দলীয় সূত্রের ইঙ্গিত, বিমানবাবুর জায়গায় রাজ্য সম্পাদক পদে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের অভিষেকে এর পরে আর বিরাট জটিলতা থাকল না। রাজ্য সম্মেলন চলাকালীনই যে ভাবে সূর্যবাবুর স্ত্রীর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজকর্ম নিয়ে তদন্ত খুঁচিয়ে তুলেছে রাজ্য সরকার, সেই ঘটনাও আখেরে বিরোধী দলনেতার পক্ষে যাচ্ছে বলে দলের একাংশের মত। কারণ এতে মনে হচ্ছে, সূর্যবাবুর বাড়তি গুরুত্ব তৃণমূলের কাছে অস্বস্তির কারণ হচ্ছে এবং তাই তারা প্রতিহিংসার পথে যাচ্ছে। সূর্যবাবুর পরিবারকে যে ভাবে সরকার নিশানা করছে, তার নিন্দা করে এ দিনই সম্মেলন থেকে রীতিমতো বিবৃতি জারি করা হয়েছে।
বিমানবাবুর জবাবি-পর্বও অবশ্য একেবারে বিতর্কহীন থাকেনি। রাজ্য নেতারা কেন ট্রেন বা বিমানে চেপে এক দিনের জন্য জেলায় গিয়ে বৈঠক করে ফিরে আসেন, তা নিয়ে সম্মেলনে প্রশ্ন তুলেছিলেন কেউ কেউ। জবাবি বক্তৃতায় বিমানবাবু বলেন, রাজ্য নেতারা গিয়েই যদি সব কাজ করে দেবেন, স্থানীয় নেতারা কি তবে ‘আঙুল চুষবেন’? এতে প্রবল আপত্তি তোলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য! শেষ পর্যন্ত ‘আঙুল চুষবেন’ কথাটি সম্মেলনের রেকর্ড থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়!