ভাগ্যিস মুকুল রায়ের কোনও পুজো নেই!
থাকলে আবার ধর্মসঙ্কটে পড়তে হতো তাঁর নেত্রীকে! যিনি আবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও বটে!
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছাপূরণে এ বারও পুজোর উদ্যোক্তাদের পুরস্কারে ভূষিত করেছে রাজ্য সরকার। যার পোশাকি নাম ‘বিশ্ব বাংলা শারদ সম্মান’। দুর্গাপুজোর মতো সামাজিক, সর্বজনীন উৎসবের আয়োজনের জন্য কিছু ক্লাবকে বেছে নিয়ে রাজ্য সরকার আদৌ পুরস্কার দিতে যাবে কেন, সেই প্রশ্ন অবশ্যই উঠতে পারে। কিন্তু তার চেয়েও বড় আকর্ষণ রয়ে গিয়েছে পুরস্কার-প্রাপকদের তালিকায়!
সরকারি শারদ সম্মানের ‘সেরার সেরা’ তালিকায় স্থান পেয়েছে কলকাতা শহরের ৬টি পুজো। চেতলা অগ্রণী সঙ্ঘ, সুরুচি সঙ্ঘ, ৭৫ পল্লি ভবানীপুর, রাজডাঙা নবোদয়, নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ এবং ঢাকুরিয়া সর্বজনীন (বাবুবাগান)। সেরা পুজোর অভিধাপ্রাপ্ত এই ৬টি আয়োজনই আসলে তৃণমূলের রত্নখচিত! চেতলা অগ্রণীর সঙ্গে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম এবং সুরুচির সঙ্গে যুবকল্যাণমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের নাম অবিচ্ছেদ্য! ঠিক যেমন নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ মানে শিক্ষামন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পুজো। ভবানীপুরের ৭৫ পল্লির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্রীড়া ও পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের নাম। বাবুবাগানের সভাপতি আর এক মন্ত্রী জাভেদ খান! আর রাজডাঙা নবোদয়ের সঙ্গে আছেন মুখ্যমন্ত্রীর অতি ঘনিষ্ঠ শিল্পী ইন্দ্রনীল সেন!তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের সচিবঅত্রি ভট্টাচার্যের পাশে বসেযিনি নিজেই পুরস্কারের তালিকা ঘোষণা করেছেন!
মুকুল ছাড়া শাসক দল এবং সরকারের জাঁদরেল পদে থেকেও শারদ সম্মানে নেই শুধু অমিত মিত্রের কোনও পুজো! তালিকার বহর দেখলে এঁদের অবশ্য ব্যতিক্রমই ধরতে হবে!
ক্ষমতায় আসার বহু আগে থেকেই ববি, অরূপের মতো তৃণমূল নেতারা অবশ্য পুজো আয়োজনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। কিন্তু বিরোধী শিবিরে থেকে পুজোয় তাক লাগিয়ে পুরস্কার জিতে নেওয়া এক জিনিস। আর মন্ত্রীর মসনদে থেকে বা মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলয়ের সদস্য হয়ে সরকারি পুরস্কার হাতে পাওয়া অন্য ব্যাপার! ঘটনাপ্রবাহ দেখে রসিক জনেরা বলছেন, এ যেন রানিমা অন্দর মহলে ধন বিলোচ্ছেন! মন্ত্রী-অমাত্যরা লুটে নিচ্ছেন! বাইরে কখনও সখনও ছিটেফোঁটা চলে আসছে। তবে তা নেহাতই গৌণ!
তৃণমূলের অন্দরেও বলাবলি হচ্ছে, বিশ্ববাংলার এই তালিকাই বলে দিচ্ছে, দিদির খাতায় কার নম্বর এখন কত! শাসক দলের এক তরুণ নেতার কথায়, “একসঙ্গে ৬-৬টা পুজো সেরা হয়েছে! মানে কেউ কারও চেয়ে কম না! সঙ্কটের বাজারে ববিদা, অরূপদা, মদনদা, পার্থদা’দের সমান নজরে দেখেছেন দিদি!” ভবানীপুর ৭৫ পল্লির পুজোকে প্রায় নিজের পুজোই মনে করেন তৃণমূল নেত্রী। তার সঙ্গেই তৃণমূলের অন্দর মহল আরও বলছে, যে পুজোর থিম রং নীল-সাদা, তার তো পুরস্কার বাঁধা! সে তার সঙ্গে মদনের নাম থাক আর না থাক! রাজনৈতিক সচেতনতার উপরে আর একটু জোর দিয়ে অন্য এক তৃণমূল নেতা জানাচ্ছেন, ৬টি ‘সেরার সেরা’ই দক্ষিণ কলকাতার। কিন্তু আগামী বছর পুরভোটে দক্ষিণের পাশাপাশি উত্তর কলকাতাকেও দরকার তৃণমূল নেত্রীর। তাই দ্বিতীয় সেরার পুরস্কার গিয়েছে উত্তর কলকাতার দু’টি পুজোর দখলে! যদিও বিজেপি-র এক নেতা ফুট কাটছেন, “উত্তর কলকাতার বেশ কিছু পুজোর উদ্বোধনে এ বার
ডাক পড়েছিল আমাদের দলের নেতাদের। তাই উত্তরের ভাগ্যে সেরার শিরোপা জোটেনি!”
শুধু শাসক দলের লোকজন পুরস্কার পাবে, আর শাসক পরিবারে কোনও সম্মান আসবে না তা-ই কি হয়? ‘সেরা ভাবনা’র নিরিখে সরকারি ওই তালিকাতেই দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে কালীঘাট মিলন সঙ্ঘ। যে ক্লাবের সঙ্গে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের কারও কারও নাম জড়িত! গুঞ্জন উঠেছে, মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের লোকের ক্লাব ‘সেরার সেরা’ তকমা পেয়ে গেল, এই লোকলজ্জাটুকু এড়াতেই কি কালীঘাটের ওই উদ্যোক্তারা অন্য শ্রেণিতে পুরস্কৃত হয়েছেন? আবার নিন্দুক কেউ কেউ এমনও বলছেন, “দিদির বাড়িতে তো অনেকভাই। পরিবারের সকলের সঙ্গে কি সমান সম্পর্ক?”
বিরোধী সিপিএম নেতারা অবশ্য মনে করছেন, মমতা-জমানায় এতে আশ্চর্যের কিছু নেই! এমনিতেই দলীয় আদর্শ মেনে পুজোর সাতে-পাঁচে তাঁদের বিশেষ থাকা হয় না। তার উপরে এখনকার রকমসকম দেখে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক বর্ষীয়ান সদস্যের মন্তব্য, “তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের সংশ্লিষ্ট কমিটির মাথায় বসানো হয়েছে ইন্দ্রনীল সেনকে। তিনি যে তালিকা পড়ে দিচ্ছেন, তাতে তাঁর নিজের পুজোও থাকছে। এই সরকারের আমলে এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে! শুধু মুকুল রায় পুজো-কর্তা নন বলে একটু পিছিয়ে পড়লেন!”
আনুষ্ঠানিক ভাবে অবশ্যই কেউ কিছু বলছেন না। তবে ঘরোয়া ভাবে তৃণমূলের এক নেতার দাবি, “কলকাতার সেরা পুজোগুলোই পুরস্কার পেয়েছে। সেরা পুজোগুলোর সঙ্গে আমাদের নেতারা জড়িত আছেন বলে কি তাদের পুরস্কার দেওয়াযাবে না?”