শিল্প গড়ার ডাক দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু সরকারে আসার তিন বছর পরেও তিনি জমি অধিগ্রহণে নারাজ। সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রেও অতি সাবধানী। ফলে বৃহৎ শিল্প তো দূরের কথা, সামান্য সেতু-রাস্তা নির্মাণের কাজও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই অবস্থায় শিল্প মহলকে খুশি করতে সিলিং অতিরিক্ত জমি রাখার ক্ষেত্রে আরও কিছু ছাড় দিতে তৎপর হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আজ, বুধবার ভূমি সংস্কার আইনে সংশোধনীও আনছেন তিনি।
কিন্তু সরকারের এই পদক্ষেপে খুশি নয় শিল্প মহল। তাদের বক্তব্য, সারা দেশ থেকে যখন সিলিং ব্যবস্থাই উঠে গিয়েছে, তখন এ রাজ্যে জমির সিলিং-ব্যবস্থা থাকবে কেন? কেন বেশি জমি রাখলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে? এই সংশোধনীতে রাজ্যের শিল্পক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তন আসবে না বলেই তাঁরা মনে করেন। কলকাতার এক বণিক সভার কর্তার কথায়, “সরকারের প্রথম কাজ বড় শিল্পের জন্য বেসরকারি সংস্থার হয়ে জমি অধিগ্রহণ করে দেওয়া। সেই কাজ যখন হচ্ছে না, তখন সিলিং ব্যবস্থা তুলে দিয়ে অন্তত বেসরকারি সংস্থাগুলির জমি কেনার ক্ষেত্রে অন্তত নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হোক। তাতে বেসরকারি উদ্যোগপতিরা অন্তত নিজেদের প্রয়োজন মতো জমি কিনে নিয়ে লগ্নি করতে পারবেন। পদে পদে সরকারের কাছে আবেদন-অনুমোদন-ছাড়পত্রের জন্য দৌড়তে হবে না।” ছাড়পত্রের জন্য শিল্পপতিদের সরকারের কাছে দৌড়তে হলেই ‘অনুগ্রহ বিতরণে’র প্রশ্ন এসে যায়। বিনিয়োগকারীদের কাছে যা কাম্য নয় বলেই মনে করে বণিক সভা।
রাজ্য সরকার অবশ্য শিল্পপতি ও বণিক মহলের চাহিদার উল্টো পথেই হাঁটছে। সিলিং ব্যবস্থা বহাল রেখেই কিছু অতিরিক্ত ক্ষেত্রকে বেছে নিয়ে প্রয়োজন মতো অতিরিক্ত জমি (২৪ একরের বেশি) রাখার অনুমতি দিতে চলেছে তারা। রাজ্য ভূমি দফতরের এক কর্তা জানান, বাম আমলে ভূমি সংস্কার আইনের ১৪ ওয়াই ধারা মেনে কেবল মিল, ফ্যাক্টরি, ওয়ার্কশপ এবং শিল্প তালুকে এই ছাড় দেওয়া হত। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে আরও কিছু শিল্পকে সিলিং অতিরিক্ত জমি রাখায় তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। প্রস্তাবিত বিলে সেই তালিকায় আরও কিছু শিল্প ও পরিকাঠামো ক্ষেত্রকে অন্তর্ভূক্ত করার কথা বলা হয়েছে। বিলের প্রতিলিপি পেয়ে কংগ্রেসের এক বিধায়কেরও বক্তব্য, “এক বারে জমি রাখার ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়ার মতো বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকার নেবে, এমন মনে করা যায় না! তবে সাড়ে তিন বছরে একটু হলেও কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙছে!”
‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ল্যান্ড রিফমর্স (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০১৪’ আজ যখন বিধানসভায় পেশ হবে, ভূমিমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন থাকবেন দিল্লিতে। তাঁর অনুপস্থিতিতে কে বিল নিয়ে জবাব (সাধারণত পরিষদীয় মন্ত্রী করে থাকেন) দেবেন এবং তিনি জমির বিষয়ে কতটা অবহিত, তা নিয়ে সরকারি পক্ষেই সংশয় রয়েছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ বিল নিয়ে পর্যালোচনা করার জন্য মাত্র এক দিন সময় পাওয়ায় বিরোধীরাও ক্ষুব্ধ। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কী থাকছে? এখন ১৪ ওয়াই ধারায় পশু-পাখি প্রজনন কেন্দ্র, পোল্ট্রি ফার্ম, ডেয়ারি, শিল্প তালুক গড়ার প্রস্তাব এলে সিলিংয়ের বেশি জমি রাখার অনুমতি দেয় রাজ্য। ছাড় দেওয়া হয়। সংশোধনীতে এরসঙ্গে সঙ্গে মৎস্যচাষ, উপনগরী, পরিবহণ নগর, পরিবহণ টার্মিনাল, লজিস্টিক হাব-সহ আরও কয়েকটি শিল্পক্ষেত্র যুক্ত হচ্ছে। শিল্পনগরী, অর্থতালুক, ওয়্যারহাউসিং, চা-বাগান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, তেল ও গ্যাস পরিবহণের পাইপ লাইনের জমি, খনি এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের জন্য জমি প্রয়োজন হলে সিলিংয়ে ছাড় দেওয়ার কথাও রয়েছে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বদল আনছে সরকার। এত দিন ভূমি সংস্কার আইনের ১৪ ওয়াই ধারা মেনে সিলিংয়ের বেশি জমি রাখায় ছাড় দিলেও তিন বছরের মধ্যে প্রকল্প রূপায়ণের কথা বলা হয়েছে। এ বার আরও দু’বছর সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। যে সব ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে, সেই প্রকল্পের সম্প্রসারণের জন্য সিলিং অতিরিক্ত জমি রাখতে হলেও সরকারের আগাম অনুমতি নিতে হবে। পাশাপাশি, লজিস্টিক হাবের জন্য সিলিং অতিরিক্ত জমি নিয়ে রাখলে সেই জমি প্রয়োজনে সাব-লিজ করার অনুমোদনও সরকার দেবে বলে প্রস্তাব বলা হয়েছে।