খনিতে মৃত ৩, মাও হানার ভুয়ো খবরে তদন্তের মুখে দুই পুলিশ

বেআইনি খনি থেকে কয়লা চুরি করতে গিয়ে ধসে চাপা পড়ে বীরভূম জেলার খয়রাশোলে মারা গিয়েছিলেন তিন জন। কিন্তু ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতে মাওবাদী হানায় তিন জনের নিহত হওয়ার মিথ্যা খবর চাউর করার অভিযোগে দুই সাব-ইনস্পেক্টরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে জেলার পুলিশ সুপারের নির্দেশে। অভিযুক্ত ওই দু’জনের এক জন ছিলেন খয়রাশোল থানার ওসি। তাঁকে সাঁইথিয়া থানার ওসি হিসেবে বদলি করা হয়েছে।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৪ ০৩:৫৮
Share:

বেআইনি খনি থেকে কয়লা চুরি করতে গিয়ে ধসে চাপা পড়ে বীরভূম জেলার খয়রাশোলে মারা গিয়েছিলেন তিন জন। কিন্তু ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতে মাওবাদী হানায় তিন জনের নিহত হওয়ার মিথ্যা খবর চাউর করার অভিযোগে দুই সাব-ইনস্পেক্টরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে জেলার পুলিশ সুপারের নির্দেশে। অভিযুক্ত ওই দু’জনের এক জন ছিলেন খয়রাশোল থানার ওসি। তাঁকে সাঁইথিয়া থানার ওসি হিসেবে বদলি করা হয়েছে। অভিযুক্ত অন্য এসআই বীরভূমে রাজ্য গোয়েন্দা শাখা বা ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ (আইবি)-এর অফিসার। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, খয়রাশোল ও তার আশপাশে কয়লার অবৈধ কারবারের বিষয়টি গোপন রাখতেই মাওবাদী হানার ভুয়ো খবর ফাঁদা হয়েছিল।

Advertisement

ওই ঘটনার সঙ্গে রাজ্য পুলিশের কর্তাদের একাংশ কিছুটা মিল পাচ্ছেন ২০১২-র ৩০ সেপ্টেম্বর জঙ্গলমহলের একটি ঘটনার। সেই রাতে পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড়ের মেটালার জঙ্গলে দু’জন সিআরপি জওয়ান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সিআরপি-র পক্ষ থেকে প্রথমে রাজ্য পুলিশের কাছে দাবি করা হয়, মাওবাদী হামলায় তাঁরা নিহত হয়েছেন। কিন্তু রাজ্য পুলিশের তদন্তে বেরোয়, মেটালার জঙ্গলে সিআরপি-র একটি শিবির চলাকালীন রাতের অন্ধকারে ভুলবশত অন্য সহকর্মীদেরই গুলিতে নিহত হন ওই দুই জওয়ান। রাজ্য পুলিশের ওই তথ্যকে পরবর্তী সময়ে সমর্থন করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট-ও।

পুলিশ সূত্রের খবর, খয়রাশোলে কয়লা চুরি করতে গিয়ে তিন জনের মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে গত ৯ মে। পরের দিন, ১০ মে খয়রাশোল থানার তদানীন্তন ওসি শেখ মহম্মদ আলি তৎকালীন এসপি রশিদ মুনির খানকে দেওয়া রিপোর্টে জানান, খয়রাশোলের কদমডাঙা গ্রামে মাওবাদী হানায় তিন জন নিহত ও আরও কয়েক জন আহত হয়েছেন। মাওবাদীরা নিকটবর্তী রূপুসপুর গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে ও ১০ মে সকাল থেকে তল্লাশি চালিয়ে কয়েক জন সন্দেহভাজনকে আটকও করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

Advertisement

কিন্তু ‘মাওবাদী হানা’র খবর জানাতে ওসি কেন ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় নিলেন, তা নিয়ে খটকা লাগে তদানীন্তন এসপি রশিদ মুনির খানের। বর্তমানে কলকাতা পুলিশের দক্ষিণ-পশ্চিম বা বেহালা ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার রশিদের কথায়, “যে ভাবে আমাকে ঘটনাটি জানানো হয়েছিল, তা থেকেই আমার সন্দেহ হয়।” তিনি তদন্তের নির্দেশ দেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায়কে। সেই রিপোর্টেই বেরিয়ে পড়ে আসল ঘটনা।

প্রকৃত ঘটনা তা হলে কী ছিল?

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, গত ৯ মে খয়রাশোল থানার গঙ্গারামচকে একটি বেআইনি খোলামুখ খনিতে কয়লা তুলতে গিয়েছিলেন স্থানীয় কদমডাঙা ও পলাশবুনি গ্রামের কয়েক জন বাসিন্দা। কয়লা ধসে চাপা পড়েন পাঁচ জন। খবর পেয়ে তাঁদের খাদান থেকে তোলেন গ্রামবাসীরা। কিন্তু ধসে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় কদমডাঙার শেখ বদ্রু (৫২), শেখ হীরালাল (২৩) ও শেখ হীরকের (২১)। সেই সঙ্গে আহত হন পলাশবুনির গৌতম ঘোষ ও শান্তি ঘোষ।

এএসপি-র রিপোর্টে বলা হয়, আইবি-র এক অফিসারের সঙ্গে যোগসাজশ করে পরের দিন একটি নকল অভিযান চালান ওসি। যেখানে আটক হয় রূপুসপুরের কয়েক জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। সেই অভিযানে সামিল হওয়ার জন্য আশপাশ এলাকার অফিসারদের খয়রাশোলে হাজির হতে সিউড়ির আইবি অফিসার স্বর্গজিৎ বসু বার্তা দেন বলে তদন্ত-রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। আটক গ্রামবাসীদের পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

কিন্তু খাদানে মৃত্যুর ঘটনাটি মাওবাদী হানা বলে চালাতে এত তৎপর হয়েছিলেন কেন পুলিশের একাংশ? বীরভূমের এক পুলিশকর্তা জানান, খয়রাশোল ও আশপাশের এলাকায় চোরাই কয়লার কারবার পুরোপুরি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এসপি এবং ওসি-দের সেই নির্দেশ কঠোর ভাবে মেনে চলতে হবে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেও খনিতে মৃত্যুর খবর বাইরে এলে প্রমাণ হয়ে যেত যে, কয়লার অবৈধ কারবার বন্ধ হয়নি। সে জন্যই খাড়া করা হয় ভুয়ো মাওবাদী-তত্ত্ব।

রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর দিনই রশিদ মুনির খান কলকাতা পুলিশে বদলি হয়ে যান। দু’জনের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেন বর্তমান এসপি অলোক রাজোরিয়া। বলেন, “ওই দুই অফিসার সঠিক তথ্য পেশ করেননি।” অভিযুক্ত প্রাক্তন ওসি-র বক্তব্য, “বিভাগীয় তদন্তে প্রমাণ করে দেব, আমি নির্দোষ।” অপর অভিযুক্ত, আইবি অফিসারের বক্তব্য বলেন, “সোর্সের কাছ থেকে খবর পেয়েই আশপাশের থানার অফিসারদের খয়রাশোলে যেতে বলেছিলাম।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement