জঙ্গি বললে জঙ্গি। রবিনহুড ভাবলে রবিনহুড।
সালিশি সভা চলছে। দড়াম করে দরজা ঠেলে ঢুকলেন এক যুবক। ঘরে বসা জনা চল্লিশ মানুষ থতমত। তাঁদের আরও হতচকিত করে দিয়ে ওই যুবক বাজখাঁই গলায় বললেন, “কে টাকা দেয়নি? আগে বাঁধো তাকে। দেখছি, টাকা না দিয়ে কী ভাবে পার পায়।”
মালদহ জেলার হবিবপুরের বারো মাইলে কালমেঘা প্রাথমিক স্কুলের হলঘরে বসেছে সালিশি সভা। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ির কাজ করাতে এলাকার ২০-২৫ জনকে বেঙ্গালুরু নিয়ে গিয়েছিলেন স্থানীয় এক ঠিকাদার। কাজ শেষ হওয়ার পর ওই মজুররা ফিরেও এসেছেন। কিন্তু তাঁদের প্রাপ্য মজুরির হাজার পঞ্চাশ টাকা কিছুতেই দিচ্ছেন না ওই ঠিকাদার। শেষমেশ এক দিন দুপুরে বসানো হয় ওই সালিশি সভা।
আর সালিশি সভা চলাকালীনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সরব অনুপ্রবেশ ওই আগন্তুকের। যাঁর বাড়ি কালমেঘা স্কুল থেকে তিন কিলোমিটার দূরে, বামনগোলার কাংসা গ্রামে। বছর চল্লিশের ওই যুবকের নাম মাধব মণ্ডল। কেএলও-তে যাঁর নাম মালখান সিংহ। পদমর্যাদায় যিনি ছিলেন ওই জঙ্গি গোষ্ঠীর সাংগঠনিক সম্পাদক।
টানা চার মাস লেগে থাকার পর শনিবার গভীর রাতে পুলিশ মালখানকে গ্রেফতার করেছে তাঁর খাস তালুক থেকেই। বামনগোলা, হবিবপুর, গাজলে ডিসেম্বরের শেষ থেকে পুলিশি তৎপরতা ভীষণ মাত্রায় বেড়ে যাওয়ার পরেও মালখান সেখানে বার বার যাতায়াত করতে পিছপা হননি। তার প্রধান কারণ ওই সালিশি সভার মতো ঘটনা।
ওই সালিশি সভায় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সিপিএম নেতা তথা পার্টির আকতৈল ব্রাঞ্চ কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক সুনীল সরকার। তাঁর কথায়, “ওই ঠিকাদারের গায়ে হাত তোলা থেকে মাধবকে আমরাই নিরস্ত করি। তবে মাধব চোটপাট করাতেই ঠিকাদার কথা না বাড়িয়ে সালিশি সভার পরেই সুড়সুড় করে টাকা মিটিয়ে দেন।”
মালখানের পরোপকারের নানাবিধ কাহিনি হবিবপুর ও বামনগোলা এই দুই তল্লাটে পাক দিলে কম শোনা যাবে না। যেমন, কাংসা গ্রামের এক যুবককে রেলে চাকরি দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাকুয়া হাটের এক ব্যক্তি চার লাখ টাকা নিয়েছিলেন। প্রতারক টাকা হাপিস করে দেওয়ার তালে থাকলেও মালখানের জন্য শেষ পর্যন্ত তা হতে পারেনি। আবার টাকার অভাবে পিতৃশ্রাদ্ধ করতে পারছেন না, এমন মানুষকে এক কথায় সাত হাজার টাকা পকেট থেকে বের করে দিয়েছেন মাধব। একই ভাবে তাঁর কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা।
এই ধরনের কাজ থেকে অর্জিত জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে মালদহ জেলাকে কেএলও-র জঙ্গি কার্যকলাপের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত করতে পেরেছিল মালখান। কেএলও-র এই দ্বিতীয় ইনিংসে জলপাইগুড়ির চেয়ে পুলিশের অনেক বেশি মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল মালদহ। অথচ জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের মতো মালদহ জেলা ভুটান ও অসমের লাগোয়া নয়। মালদহে বসে আলফা, এনডিএফবি-র মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর সহযোগিতা পাওয়া মুশকিল। তা সত্ত্বেও কেএলও-র হিংসাত্মক কার্যকলাপের ঘটনার সংখ্যার বিচারে মালদহ ২০১৩ সালে জলপাইগুড়িকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। কারণ হিসেবে পুলিশ ও গোয়েন্দারা দুর্ধর্ষ জঙ্গি মালখান সিংহের কথাই বলেন। কিন্তু সযত্নে এড়িয়ে যান মাধব মণ্ডলের পরোপকারী সত্তার কথা।
তবে মাধবের ওই পরোপকারী সত্তার পাশাপাশি হবিবপুর ও বামনগোলার এক বিস্তীর্ণ অংশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা অংশকে প্রচলিত ব্যবস্থা বা ‘সিস্টেম’-বিরোধী ও মালখান-সমর্থক করে তুলেছে। হবিবপুর ও বামনগোলার জাহানাবাদ, ঝিনাইকুড়ি, ধেরেন্দা, কালনা, জামালপুর, বিনোদপুর, লক্ষ্মীতোড়ের মতো গ্রামে মালখান গত চার মাস ধরে ঘন ঘন যাতায়াত করেছে, রাত কাটিয়েছেন অবলীলায়। মালখানকে গ্রেফতার করে লোকসভা ভোটে মালদহে কেএলও-র নাশকতা ঘটানোর ঝুঁকি এক রকম কাটিয়েই দেওয়া গেল বলে পুলিশের আশা। অবশ্য একই সঙ্গে পুলিশকর্তারা স্বীকার করে নিচ্ছেন, মালখানকে গ্রেফতার করার মধ্যে দিয়ে ওই সব গ্রামের মানুষের ক্ষোভ শেষ হয়ে যাচ্ছে না।
মালদহ-নালাগোলা রাজ্য সড়ক ধরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উজিয়ে গেলে দু’ধারে পড়বে ওই সব গ্রাম। বাসিন্দারা রাজবংশী নয়তো আদিবাসী। গ্রামের অবস্থান বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা, নয়তো জঙ্গল ঘেরা। দু’বছর বৃষ্টি হয়নি বলে ধান ফলেনি কোনও মাঠে। সেচের ব্যবস্থা নেই। পানীয় জল বলতে সরকারি ইঁদারা, যা আবার গ্রীষ্মে শুকিয়ে যায়। কোথাও একশো দিনের কাজ গত বছর খুব বেশি হলে বারো দিন মিলেছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দূরত্ব আট কিলোমিটারের কম নয়। উন্নয়নের একমাত্র চিহ্ন বলতে সদ্য হওয়া বিদ্যুদয়ন। অথচ প্রতিটি গ্রামে জনা দশেক শিক্ষিত বেকার যুবক।
জাহানাবাদ গ্রামের খগেন্দ্রনাথ রায়ের বক্তব্য, “গ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে সরকার, বিরোধী কারও মাথাব্যথা নেই। ভোট ব্যাপারটাই এখন আমাদের কাছে বিরক্তিকর।” চমকে উঠতে হয় ওই গ্রামের সুনীল রায়, প্রফুল্ল মণ্ডলদের কথায়, “আমরা, রাজবংশীরা এখানকার ভূমিপুত্র। অথচ আমরাই ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছি। সেই ব্যাপারে কিন্তু সরকারের খেয়াল নেই।” এই কথাই তো দু’দশক ধরে বলে আসছে কেএলও। মানে, মালখানের সংগঠন।
রাজ্য পুলিশের উত্তরবঙ্গের আইজি জাভেদ শামিম বলেন, “ওই সব গ্রামের অবস্থার কথা মাথায় রেখে মালখানকে ধরতে সতর্ক হয়ে এগোই। সামনে ভোট। এতটুকু বাড়াবাড়ি হলে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠত।” এমনকী, গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঢুকে পুলিশ সে ভাবে তল্লাশি করেনি।
আসলে দেরিতে হলেও প্রশাসন এখন কিছুটা বুঝতে পারছে, রাজবংশী ভাবাবেগে কোনও ভাবেই আঘাত করা চলবে না। এ দিকটায় খেয়াল না রাখাতেই কিন্তু টম অধিকারী, মনচলাল সিংহ, ইকবাল সিদ্দিকি, তরুণ থাপা ও মালখান সিংহরা জেল থেকে এক বার বেরিয়ে ফের ২০১২-র মাঝামাঝি চলে যান জঙ্গি শিবিরে।
গত চার মাসে উত্তরবঙ্গের এই পাঁচ ‘বিপদ’-ই ধরা পড়ে যাওয়ার পর এখন দেখার রাজবংশীদের দাবি-দাওয়াকে সরকার কী ভাবে গুরুত্ব দেয় কিংবা উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায় প্রভাবিত হতদরিদ্র এলাকার উন্নয়নের ব্যাপারে সরকার মনোযোগী হয় কি না। না হলে হলকাটুকুই যা কিছু দিন থাকবে না, আগুন সেই ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকবে।
(শেষ)