সংখ্যার বিচারে তাঁদের জেতা ম্যাচ। তবু সেই ম্যাচেই পর পর ভুল পাসে বিড়ম্বনা ডেকে আনলেন মন্ত্রীরা! বিরোধীরা যাকে বলছেন আত্মঘাতী গোল!
বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় মন্ত্রীদের যুক্তি পাল্টা ব্যবহার করেই সরকার পক্ষকে বিড়ম্বনায় ফেলল বামেরা। কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক ডেকে মঙ্গলবার সকালে ঠিক হয়েছিল, এ দিনই বামেদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে তিন ঘণ্টার বিতর্ক হবে বিধানসভায়। এক লাইনের অনাস্থা প্রস্তাব ছিল রাজ্য মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে। কিন্তু মন্ত্রিসভার প্রধান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন দিল্লিতে। তাঁর অনুপস্থিতিতে সরকারকে ‘রক্ষা’ করার দায়িত্ব এসে পড়েছিল মন্ত্রিসভায় মুখ্যমন্ত্রীর বিশ্বস্ত সেনাপতিদের উপরে। এবং তাঁরাই অতি আক্রমণাত্মক হতে গিয়ে এমন কিছু প্রশ্ন তুললেন, যা আবার ফিরে এল তাঁদের দিকেই!
অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র যেমন। অনাস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সরকারের হয়ে প্রথম বলে উঠে বিস্তর তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, নানা ক্ষেত্রেই সরকারের অগ্রগতি আস্থাজনক। কিন্তু শেষে তিনি কটাক্ষ করতে গেলেন অনাস্থার উত্থাপক, বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রকে। অমিতবাবুর মন্তব্য ছিল, “লোকসভা ভোটের ফলাফল অনুযায়ী, মাননীয় বিরোধী দলনেতার নিজের কেন্দ্র নারায়ণগড়ের মানুষ কি তাঁর উপরে আস্থা রেখেছেন? তা হলে তিনি আর কাদের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনছেন?”
অমিতবাবুর এই মন্তব্য লুফে নিয়ে সরব হন আরএসপির সুভাষ নস্কর, সিপিআইয়ের আনন্দময় মণ্ডলেরা। আনন্দবাবু বলেন, “লোকসভা ভোটের ফলে ভবানীপুরে তো মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী হেরেছেন! তা হলে তাঁর প্রতি তাঁর এলাকার মানুষের অনাস্থা কি প্রমাণিত নয়?” ফরওয়ার্ড ব্লকের উদয়ন গুহ আরও এক ধাপ এগিয়ে প্রশ্ন তুললেন, “তাঁর পিছনের আসনে মুখ্যমন্ত্রী থাকলে কি অমিতবাবু নারায়ণগড় নিয়ে কথা বলার সাহস পেতেন?” তখন দৃশ্যতই অস্বস্তি শাসক শিবিরে!
বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও চেষ্টা চালান বামেদের বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণাত্মক হয়ে তাদের দিশাহারা করে দিতে। বলেছিলেন, বামেদের সঙ্গে আর লোক নেই। তাদের প্রতি অনাস্থা দেখিয়ে লোক চলে যাচ্ছে আর তাঁরা বিধানসভায় সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনছেন! সপিএম বিধায়ক আনিসুর রহমান বলেছেন, “সুব্রতবাবু এত বার দল বদলেছেন, এ সব জানেন! কখন কার প্রতি আস্থা থাকে, বোঝা দায়!” বামেদের অনাস্থায় বিস্তর আক্রমণ ছিল সারদা-কাণ্ড নিয়েও। কুণাল ঘোষ ও আসিফ খানের নাম না করে কৌশলে আক্রমণ শানিয়েছিলেন উদয়নবাবুই। তাঁর বক্তব্য, “আমরা তো বলিনি মুখ্যমন্ত্রী অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত! যাঁরা বলেছেন, তাঁদের টাকা এখনও তৃণমূলের তহবিলে যাচ্ছে!”
বিড়ম্বনার হাত থেকে বাদ যাননি শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। সরকারি তরফে শেষ বক্তা ছিলেন তিনিই। অনাস্থা-বিতর্কে মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতি নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পার্থবাবু বলেন, সংসদেও এমন নজির আছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী বিদেশে ছিলেন, তখন সংসদে অনাস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সূর্যবাবু বলেন, “পার্থবাবু যখন এ সব বলছেন, এই বিতর্কে তাঁকেই তা হলে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সম্বোধন করব!” হাসতে গিয়েও বিড়ম্বনার ভয়ে তখন চেপে যাচ্ছেন শাসক দলের একাধিক বিধায়ক! আর বিরোধীদের কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রীর যদি কানে যায়, তিনি না-থাকায় অন্য কেউ মুখ্যমন্ত্রীর সম্মান পেয়েছেন, তবে কী হবে!”
সূর্যবাবু অবশ্য অনাস্থা-বিতর্ক শেষ করেছেন এই বলে, “নিজের সরকারের উপরে আস্থা থাকলে মুখ্যমন্ত্রী জবাব দিতে হাজির থাকতেন!” বিতর্কে অংশ নিয়ে বিজেপি-র শমীক ভট্টাচার্য এবং এসইউসি-র তরুণ নস্কর বাম জমানার অন্যায় উল্লেখ করেও আইনশৃঙ্খলা নিয়ে মমতা-জমানাকে নিশানা করতে ছাড়েননি। কংগ্রেস অবশ্য বয়কট করেছিল স্পিকার তাদের অনাস্থা প্রস্তাব ঝুলিয়ে রাখায়।