তিনি নৈঃশব্দ্য ভাঙলেন। ২০১৮ সালের পর ২০২২— চার বছর লাগল সেই নীরবতা ভাঙতে। তবে প্রকাশ্যে মুখ খুলেই শোভন চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলন নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে, কেউ যদি প্রতিবাদ না-ও করে তবে একটি মানুষ মুখ খুলবে।’’ সেই একটি মানুষ তিনি, শোভন চট্টোপাধ্যায়।
শোভন চিরকাল মমতার অনুগামী এবং অনুগত হয়ে কাজ করেছেন। খুব অল্প বয়সে কংগ্রেসের কাউন্সিলর হন। পরে ১৯৯৮ সালে মমতা যখন কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গঠন করেন, তার পরে ২০০০ সাল থেকেই মমতার সঙ্গে ছিলেন শোভন। দু’জনের সম্পর্কে নানা সময়ে ওঠাপড়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বরাবর মমতা আর শোভনের সমীকরণ ছিল অন্য স্তরের। শোভনকে মমতা ‘কানন’ বলে ডাকেন।
সোমবার মমতার বিরুদ্ধে শুভেন্দুর আক্রমণাত্মক মন্তব্য শোনার পর ‘প্রতিবাদ’ জানিয়েছেন শোভন। শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, নন্দীগ্রাম এবং শান্তিকুঞ্জ ছাড়া মমতা জনপ্রিয় হতে পারতেন না। তিনি মুখ্যমন্ত্রীও হতে পারতেন না। শোভন পাল্টা শুভেন্দুকে বলেছেন, তাঁরা দু’জনেই মমতার হাতে গড়া। সে কথা যেন শুভেন্দু ভুলে না যান। উল্লেখ্য, শোভন যখন এ কথা বলছেন, তার মাস খানেক আগেই তিনি নবান্নে গিয়ে দেখা করেছেন মমতার সঙ্গে। অন্য দিকে, বিজেপির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ঠেকেছে তলানিতে।
মমতার সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল শোভনের। বরাবর মমতার পারিবারিক বিষয় সামলেছেন শোভন। মমতার মায়ের অসুস্থতা থেকে শুরু করে আরও নানা বিষয় দেখেছেন তিনি। বস্তুত শোভন ছিলেন মমতার একেবারে বাড়ির লোক।
আবার শোভনকে কলকাতার মেয়রও করেছিলেন মমতাই। শোভন মেয়র হিসেবে নিজের দক্ষতার পরিচয় দেওয়ার পর তাঁকে মেয়রের দায়িত্বের পাশাপাশি রাজ্যের আরও তিনটি দফতরের মন্ত্রী করেন মমতা। ঠিক এই সময়েই শোভনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একটি ডামাডোল তৈরি হয়।
শোভন, তাঁর স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায় এবং শোভনের বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক গোটা রাজ্যে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। উল্লেখ্য, শোভনের স্ত্রী রত্নাও ছিলেন মমতার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। যিনি বর্তমানে রাজ্যের বিধায়ক এবং কাউন্সিলরও।
শোভনের ব্যক্তিগত জীবনের এই পরিস্থিতি নিয়ে সেই সময় মমতার সঙ্গে বেশ কয়েক বার কথা হয় শোভনের। ভাল কথায় বোঝানোর পাশাপাশি তাঁর প্রিয় কাননকে হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন মমতা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুতেই কিছু হয়নি। ২০১৮সালের নভেম্বরে শোভন তাঁর সমস্ত দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেন। নবান্নে গিয়ে ইস্তফাপত্র জমা দিয়ে কার্যত রাজনৈতিক বানপ্রস্থে চলে যান কলকাতার প্রাক্তন মেয়র।
২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের পর ১৪ অগস্ট দিল্লিতে গিয়ে শোভন এবং তাঁর বান্ধবী বৈশাখী বিজেপিতে যোগ দেন। যদিও সেই যোগদান নিয়ে গোড়া থেকেই শুরু হয় বিতর্ক।
বিজেপির রাজ্য সংগঠনে শোভন-বৈশাখীর অবস্থান নিয়ে রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে এই জুটির টানাপড়েন চলতে থাকে। শেষে বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় শোভন-বৈশাখীর। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এই গোটা ঘটনাটি যখন চলেছে, তখন শোভনের দলবদল নিয়ে এক রকম নীরবই ছিলেন মমতা।
তবে তৃণমূলনেত্রী মুখে কিছু না বললেও শোভনের ছেড়ে যাওয়া কেন্দ্রে বিধানসভা ভোটের টিকিট দেন তাঁর স্ত্রী রত্নাকে। রত্না ওই কেন্দ্রে জয়ীও হন। পরে পুরসভা ভোটেও ওই এলাকার কাউন্সিলর হিসাবে টিকিট দেওয়া হয় শোভনের স্ত্রীকেই।
এক কালে ‘ভাই-দিদি’ বলে ডাকা হত দু’জনকে। প্রকাশ্যে তাঁদের ঠাট্টা-খুনসুটি করতেও দেখা গিয়েছে বহুবার। শোভনকে একবার মজা করার জন্যই সবার সামনে সুইমিং পুলের জলে ফেলে দিয়েছিলেন মমতা। শোভন অবশ্য হাসতে হাসতেই উঠে এসেছিলেন জল থেকে। বিন্দুমাত্র অনুযোগ করেননি।
আবার বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদলের আগে শোভনই ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় মমতার ভরসা। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে যে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছিল, তাতে দু’টি জেলা পরিষদ এসেছিল তৃণমূলের হাতে। একটি পূর্ব মেদিনীপুর এবং অন্যটি দক্ষিণ ২৪ পরগণা। শোভনের সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতায় তৈরি দক্ষিণ ২৪ পরগনা কখনও ফেরায়নি মমতাকে। অধুনা প্রয়াত অরূপ ভদ্রের হাত থেকে সভাপতিত্ব নিয়ে শোভনের হাতেই দেন মমতা। চেয়েছিলেন দলের অন্তর্কলহ মেটাতে।
এমনকি যে নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকে তৃণমূলের উত্থান, তার শুরুর দিনেও শোভনই ছিলেন মমতার সঙ্গে। সোমবার যখন মমতাকে লক্ষ্য করে শুভেন্দুর আক্রমণের জবাব দিচ্ছেন শোভন, তখনও তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে সে দিনের কাহিনি। শুভেন্দুকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে শোভন বলেছেন, ‘‘নন্দীগ্রামে যে দিন গুলি চলল, সে দিন আমি ছিলাম মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে। উনি ঝরঝর করে কাঁদছিলেন। বলছিলেন, ‘ওরা সবাইকে মেরে ফেলল। চল কানন একবার নন্দীগ্রামে যাই।’ তখন কোথায় ছিলেন?’’
শোভন বলেছেন, ‘‘সে দিন নন্দীগ্রামে যাওয়ার পথে মমতাকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করা হয়েছিল। আমি যেতে দিইনি। উনি জেদ করেছিলেন, তা-ও যেতে দিইনি। চণ্ডীপুরে সে দিন কোথায় ছিলেন শুভেন্দু যিনি নন্দীগ্রাম আন্দোলনের হোতা বলে নিজেকে দাবি করেন!’’
কয়েক মাস আগেই বান্ধবী বৈশাখীকে নিয়ে নবান্নে গিয়েছিলেন শোভন। মমতার সঙ্গে দেখা করেন। কী কথা হয়েছিল জানা যায়নি, তবে বৈশাখী বলেছিলেন, ‘‘অভিমানের দেওয়াল ভেঙেছে।’’ অন্য দিকে রাজনৈতিক মহলে একটি খবরও ছড়ায়। শোনা যায়, ২১ জুলাই তৃণমূলের শহিদ দিবস পালনের মঞ্চে বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দেবেন শোভন।
শোভনের রাজনৈতিক দক্ষতা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে দ্বিমত ছিল না কখনও। বরং প্রশংসাই শোনা যেত। শোভন একজন দক্ষ প্রশাসক, তাঁকে কিছু বলা হলেই তিনি দ্রুত গতিতে তা করে দেন, সবাইকে নিয়ে চলতে জানেন— এমন নানা কথাই শোনা যেত তাঁর সহকর্মী এমনকি তৃণমূলনেত্রীর মুখেও।
কিন্তু বৈশাখী এবং বিজেপি পর্বের পর শোভনের এই নৈশঃব্দ্য ভেঙে প্রত্যাবর্তনে কি মমতার সঙ্গে তাঁর পুরনো সমীকরণও ফিরবে?