— প্রতীকী চিত্র।
আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসকের খুন ও ধর্ষণের ঘটনার পরে নাগরিক প্রতিবাদের স্বর তখনও তেমন দানা বাঁধেনি। সবে ডাক দেওয়া হয়েছে ‘মেয়েদের রাত দখল’-এর। ১৪ অগস্ট, স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন। ঠিক সেই রাতে খুন হয়ে গেলেন এক তরুণী। বর্ধমানের নান্দুরে। সম্পর্কে টানাপড়েনেই প্রিয়াঙ্কা হাঁসদা নামে ওই তরুণীর গলার নলি কেটে খুন করা হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে।
আর জি কর আন্দোলনের আঁচ ক্রমে বাড়তে শুরু করেছে। খুন হয়ে গেল এক বালিকা। ধর্ষিত হয়ে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক গ্রামে।
একই সময়ে পটভূমি উত্তরবঙ্গও। আলিপুরদুয়ার জেলায় এক গ্রামে ধর্ষিত হয়ে খুন আর এক নাবালিকা।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সকালে নদিয়াতেও। একটি মণ্ডপের পাশে মিলল এক তরুণীর অর্ধদগ্ধ দেহ। অভিযোগ, ধর্ষণ করে খুনের। যদিও তদন্তে আত্মহত্যার সম্ভাবনা খারিজ করা হয়নি। কিন্তু আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিল কে?
৯ অগস্ট থেকে অক্টোবরের শেষ, মাস তিনেকের মধ্যে পরপর এই ঘটনাগুলি একটি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে: রাজনৈতিক ভাবে যে দাবিটা বার বার করা হয় শাসক দলের পক্ষ থেকে, তা কতটা ঠিক? মেয়েদের পক্ষে কতটা সুরক্ষিত এই রাজ্য?
খোদ লালবাজারের কর্তারা জানাচ্ছেন, রাজ্যে অন্য সব এলাকা যদি বাদও দেওয়া যায়, গত ছ’মাসে শুধু কলকাতার সব ক’টি থানা মিলিয়ে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ জমা পড়েছে প্রায় সাড়ে ছ’শো। অর্থাৎ মাসে গড়ে প্রায় একশোটি করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ। তার পরেই রয়েছে পথে বেরিয়ে হেনস্থা। আর গত দু’মাসে উল্লেখযোগ্য ভাবে সামনে এসেছে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের হেনস্থার অভিযোগ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে, রাজ্য জুড়ে মেয়েদের উপরে
অত্যাচার ও হিংসার বিভিন্ন ঘটনা।
একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনাটি কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপারের অফিসের কাছে। আঠারো বছরের এক তরুণীর অগ্নিদগ্ধ দেহ মেলে সেখানে। এর মধ্যেই অবশ্য বর্ধমানের তরুণী খুনে মূল অভিযুক্ত, পশ্চিম মেদিনীপুরের বাসিন্দা অজয় টুডুকে গ্রেফতার করে দু’মাসের মাথায় চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। গত ১৫ অগস্ট উত্তরবঙ্গের এক শহরে এক নাবালিকাকে মাঠে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। সে ক্ষেত্রেও দ্রুত ধরা পড়ে চার জন। দুর্গাপুজোর ঠিক আগে উত্তরবঙ্গের নাগরাকাটার সুখানি ঝোরায় ১৯ বছরের এক আদিবাসী মেয়ের দেহ ভাসতে দেখা যায়। খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হয় স্থানীয় এক যুবক।
তবে কি তৎপরতা বেড়েছে পুলিশের? তারা কি মেয়েদের উপরে অত্যাচারের অভিযোগ দ্রুত নথিভুক্ত করে তদন্ত চালাচ্ছে? বিশেষ করে আর জি করের পরে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার জেরেই কি ‘পরিবর্তন’?
প্রশাসনেরই কোনও কোনও কর্তাব্যক্তি বলছেন, সে কথাও হলফ করে বলা সম্ভব নয়। না হলে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘটনায় নাবালিকা যখন বাড়ি থেকে নিখোঁজ, তখন সেই অভিযোগ নিতে পুলিশ দেরি করল কেন? পরিবারের অভিযোগ, তা হলে হয়তো ঘটনা আটকানো সম্ভব হত। বাঁচানো যেত শিশুটিকে।
অথচ ন্যাশনাল ক্রাইম রের্কড ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ এবং ২০২২ সালে দেশের প্রধান শহরগুলির মধ্যে সব থেকে নিরাপদ কলকাতা। তা হলে কি মেয়েদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ নিতে না চাওয়ার প্রবণতা লুকিয়ে রয়েছে এই পরিসংখ্যানে? অবশ্য ওই পরিসংখ্যানই বলছে, মহিলাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের নিরিখে দেশে চতুর্থ স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। মহিলাদের উপরে হামলা দিল্লি এবং মুম্বইয়ের তুলনায় কলকাতায় কম হলেও চেন্নাই বা আমদাবাদের থেকে বেশি। তবে অপরাধের অভিযোগ না নিতে চাওয়ার ব্যাপারে বিরোধীদের দাবি যদি ঠিক হয়, তবে এই স্থান আরও কয়েক ধাপ গড়িয়ে যেতে পারে নীচের দিকে।
সংশ্লিষ্ট মহল অবশ্য বলছে, আর জি করের ঘটনার পরের আন্দোলনের চাপ পড়েছে পুলিশ-প্রশাসনের উপরে। ফলে অভিযোগ নথিবদ্ধ করা এবং তদন্তে কিছুটা হলেও গতি এসেছে। আর জি কর-পরবর্তী ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেফতারিই তার ইঙ্গিত।
যদিও তাতে তৃণমূল আমলে শহর, গ্রাম, মফস্সলে নাবালিকা থেকে প্রৌঢ়া, এমনকি বৃদ্ধাদের উপরে ঘটে যাওয়া অপরাধগুলির গুরুত্ব খাটো হয়ে যায় না। খোদ কলকাতার বুকে পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণ মামলায় প্রশাসনের ভূমিকা কেমন ছিল, তা নিয়ে এখনও নাগরিক সমাজে আলোচনা হয়। নদিয়ার গাংনাপুরে এক গির্জায় ‘মাদার সুপিরিয়র’-কে গণধর্ষণ, কামদুনি বা ২০২২ সালে নদিয়ায় গণধর্ষণে নাবালিকার মৃত্যুর পরে তড়িঘড়ি দেহ পুড়িয়ে ফেলা— এমন বহু ঘটনা রয়েছে, যে সব ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত অভিযুক্তদের পাকড়াও করা হলেও তদন্ত ও বিচারের বিভিন্ন সময়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সন্দেহ তৈরি হয়েছে, প্রশাসনের একাংশ কি বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে চায়?
ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থার পাশাপাশি বেড়েছে অন্য অপরাধও। পুলিশ জানাচ্ছে, লকডাউন-উত্তর সময়ে উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে শিশুশ্রম এবং পাচার। পুলিশেরই সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, পাচারে বেশির ভাগই মেয়ে। আগে ৮ থেকে ১৪ বছরের মেয়ে বেশি পাচার হত। গত তিন বছরে বেশি পাচার হয়েছে ১৫ থেকে ২১ বছর বয়সি মেয়েরা।
অন্য অপরাধের উদাহরণও দেখাচ্ছেন প্রশাসনিক কর্তারা। পুলিশ সূত্রের খবর, ২০২৪ সালে মে মাস পর্যন্ত পশ্চিম মেদিনীপুরে মহিলাদের উপরে অত্যাচার ও অপরাধের নথিবদ্ধ অভিযোগ ১,১৬৫টি। এর মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগ ২৮টি। এই জেলায় ধর্ষণের অভিযোগ ২০২৩ সালে ৮১টি, ২০২২-এ ৭৬টি ও ২০২১ সালে ৪৩টি ছিল। পূর্ব বর্ধমানে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নারী নির্যাতন সংক্রান্ত ২,৬৪৪টি মামলা জেলার বিভিন্ন থানায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। তার মধ্যে অপহরণ সংক্রান্ত অভিযোগ রয়েছে ৬২৬টি। ধর্ষণের অভিযোগ ৩৩টি, গণধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে ৫টি।
অর্থাৎ, কর্তারা দেখাচ্ছেন, যৌন নির্যাতনের থেকে অন্যান্য অপরাধের সংখ্যা অনেক বেশি। তার মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অপহরণ। এমন ঘটনা কী ভাবে আটকানো সম্ভব? মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার সূর্যপ্রতাপ যাদব বলেন, “মহিলাদের নিরাপত্তায় পুলিশের নজরদারি, টহলদারি চলছে। মহিলা পুলিশের উইনার্স দল এবং পিঙ্ক পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় টহল দিচ্ছে।”
বস্তুত, এমন সব বাহিনী কাজ করছে সব জেলাতেই। মহিলা পুলিশকর্মীদের বাইক বাহিনী টহলের ফাঁকে নিজেদের ফোন নম্বর পথচলতি মহিলাদের দিচ্ছে, যাতে বিপদে পড়লে যোগাযোগ করা যায়। স্কুলে মেয়েদের ক্যারাটে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, স্পর্শের ভাল-মন্দ বোঝাচ্ছেন পুলিশকর্মীরা।
এত কিছুর পরেও যৌন নির্যাতন থেকে গার্হস্থ্য হিংসা— মেয়েদের উপর অপরাধের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কেন?
(চলবে)