স্মৃতি: শম্পার ছবি হাতে শিখাদেবী। নিজস্ব চিত্র
সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। জল থেকে একে একে পাড়ে উঠছে সাঁতারুরা। অপেক্ষারত বাবা-মায়েদের ভিড় থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে এক প্রৌঢ়া। বিড়বিড় করে বলছেন, ‘‘মেয়েটা উঠে এলেই শাক আর ছোলা সেদ্ধ করে দিতে হবে।’’
সন্ধ্যা নামল। হাতের মুঠোয় ছোট ব্যাগ আঁকড়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালেন প্রৌঢ়া মা। অশক্ত শরীরে কোনও মতে বাড়ির সামনে পৌঁছলেন তিনি। কিন্তু বাড়ি ঢুকতে তাঁর যে মন চায় না।
কেন? ছোট্ট এক কামরার ঘরে ঢুকলেই মনে পড়বে, জল থেকে আর কোনও দিন উঠে আসবেন না তাঁর মেয়ে। ১১ বছর আগে বোধনের আগেই মেয়ের বিসর্জন হয়েছে।
২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। দিনটা ছিল মহালয়া। ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলেন বালির রাধানাথ ব্যানার্জি লেনের বাসিন্দা শম্পা দাস। সকাল থেকেই মনটা চঞ্চল ছিল ছাব্বিশ বছরের শম্পার। সে দিন চুঁচুড়া থেকে চন্দননগর পর্যন্ত ছিল গঙ্গায় ১০ কিলোমিটার সাঁতার প্রতিযোগিতা। শিখাদেবী বলেন, ‘‘সে দিন সকালে ভাল করে কিছু খায়নি মেয়েটা। প্রায় খালি পেটেই চলে গিয়েছিল চুঁচুড়ায়। বলেছিল, গঙ্গায় সাঁতরে ফার্স্ট হয়ে ফিরে বাবার ছবিতে মালা দেবে।’’ শিখাদেবী দুপুরে পৌঁছে গিয়েছিলেন চন্দননগরের জোড়াঘাটে। ভিড়ে ঠাসা গঙ্গার ঘাটে মা অপেক্ষায় ছিলেন, কত ক্ষণে এক্কেবারে প্রথমে উঠে আসবেন জাতীয় স্তরে ২৩টি পদক জেতা মেয়ে।
একে একে সফল সাঁতারুরা যখন পাড়ে উঠে আসছিলেন, তখন মেয়ের দেখা না পেয়ে মায়ের মন কু গাইতে শুরু করেছিল। আচমকাই তিনি দেখেছিলেন, শম্পাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসছেন কয়েক জন। ‘কী হয়েছে ওর?’— উত্তর পাননি মা। সকলের সঙ্গে তিনিও ছুটে গিয়েছিলেন চন্দননগর হাসপাতালে। ‘আপনার মেয়ে মারা গিয়েছে’— চিকিৎসকদের কথা শুনে টেবিল উল্টে দিয়ে বারবার মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে ডাকলেও ঘুম ভাঙেনি শম্পার।
সেই থেকে আজও একাই ঘুম ভাঙে শিখাদেবীর। ২০০৫ সালে রেলে চাকরিরত অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন স্বামী হারুগোপাল দাস। ছোট থেকে জলে ভয় পাওয়া শম্পাকে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়েই জোর করে বালি সুইমিং সেন্টারে ভর্তি করে দিয়েছিলেন হারুগোপাল। তিনিই ছিলেন মেয়ের অনুপ্রেরণা। আচমকা বাবার মৃত্যুর পরে তাঁর চাকরিতে যোগ দিয়ে কিছু দিন সাঁতারে ইতি টানেন শম্পা। ‘‘স্নাতক হয়েও কেন সাফাইয়ের কাজ করবে? লুকিয়ে ওর অফিসে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতাম। জানতে পেরে মেয়ে খুব অভিমান করত’’— বললেন শিখাদেবী।
‘‘আজ আর কেউ অভিমান করে না। মাথার উপরে কেউ তো নেই। কে দেখবে আমায়’’ — আক্ষেপ ঝরে পড়ে প্রৌঢ়ার গলায়। দিশাহীন ভাবে ঘুরে বেড়ান এ-পাড়া থেকে ও-পাড়ায়। কখনও শ্যামনগর, কখনও চুঁচুড়ার সাঁতার ক্লাবে গিয়ে খোঁজেন মেয়েকে। ব্যাগে থাকে মেয়ের চাকরি আর প্রতিযোগিতার পরিচয়পত্র, ছোট অ্যালবাম। কখনও গভীর রাতে থানায় গিয়ে জানতে চান, মেয়েটা কেন এখনও বাড়ি ফিরল না? অগোছালো ঘরের আলমারিতে আজও পুঁটুলিতে বাঁধা রয়েছে শম্পার অজস্র মেডেল, শেষ সাঁতারে পরা কস্টিউমটাও।
কয়েক বছর আগে শম্পার নামে ক্লাবঘর বানিয়েছেন বালি সুইমিং সেন্টারের কর্তারা। বাড়ি থেকে কয়েক পা দূরে হলেও সে দিকে যান না শম্পাদেবী। বললেন, ‘‘ওখানে গেলেই তো মনে হবে শম্পা সাঁতার কাটছে।’’ বড্ড খেতে ভালবাসতেন শম্পা। আজ আর মেয়ের খাওয়া হয় না ভেবে অর্ধেক দিন রান্না করেন না শিখাদেবী। ‘‘জলে নামার আগে শারীরিক পরীক্ষায় কি কিছু বোঝা যায়নি? কী হয়েছিল মেয়েটার?’’ ১১ বছরের পুরনো প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়ান তিনি।
উত্তর মেলে না। সকলের স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া মেয়ের ছবি কোলে নিয়ে মুখ নিচু করেন মা।