(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
রামমন্দির উদ্বোধনের দিন হাজরা থেকে পার্ক সার্কাস পর্যন্ত ‘সংহতি মিছিল’ করবেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই মিছিলে কি হাঁটবেন তৃণমূলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়? শাসকদলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে ‘শৈত্য’ নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন সোমবার অভিষেক কী করবেন, তা নিয়েও তৃণমূলের অন্দরে জল্পনা তৈরি হয়েছে।
শনিবার বিকাল পর্যন্ত অভিষেকের থাকা না থাকার বিষয়ে তৃণমূলের তরফে স্পষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি। বরং অভিষেক ঘনিষ্ঠেরা বলছেন, মিছিলের যে প্রচার করা হচ্ছে, তাতে কেবল মমতার নামই রয়েছে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় সংহতি মিছিলের যে হোর্ডিং পড়েছে, তাতেও রয়েছে কেবল নেত্রীর ছবি এবং নাম। অভিষেকের নাম বা ছবি তাতে নেই। এ থেকেই অনেকের ধারণা, অভিষেক সোমবারের মিছিলে না-ও থাকতে পারেন। শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই দিন তাঁর অন্য কোনও কর্মসূচির কথাও অবশ্য জানা যায়নি। ফলে অভিষেক যে থাকবেনই না, তা-ও কেউ জোর দিয়ে বলতে চাইছেন না।
অভিষেক সাধারণত কোনও ‘সরকারি কর্মসূচি’তে থাকেন না। কিন্তু দলীয় কর্মসূচিতে তিনি থাকেন। কারণ, সংগঠনে তাঁর স্থান তৃণমূলের চেয়ারপার্সন মমতার ঠিক পরেই। অভিষেক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। ঘটনাচক্রে, সোমবারের মিছিল কোনও ‘সরকারি’ কর্মসূচি নয়। সেটি ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি’। ফলে এমনিতে সেটিতে থাকতে অভিষেকের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু একইসঙ্গে মমতা ওই মিছিলকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে চাইছেন। সে কারণেই তিনি মিছিলের শেষে পার্ক সার্কাসের মঞ্চে কোনও রাজনীতিককে রাখতে চাইছেন না। ফলে সে অর্থে ওই মিছিলকে তৃণমূলের ‘দলীয় কর্মসূচি’ও বলা যাবে না।
তবে অভিষেককে মমতা যদি মিছিলে অংশ নিতে বলেন, তা হলে তিনি সেখানে যাবেন বলেই দলের একাংশ মনে করছেন। যেমন, দিন দশেক আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা নেতৃত্বকে কালীঘাটের বাড়িতে বৈঠকে ডেকেছিলেন মমতা। সে দিন দুপুর পর্যন্ত জানা যায়নি, দলের পদাধিকারী অভিষেক বৈঠকে যাবেন কি না। তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, সে দিন দুপুরে অভিষেককে জানানো হয়, তাঁর বৈঠকে থাকা উচিত। নইলে গোটা দলের কাছে ‘ভুল বার্তা’ যাবে। শেষ পর্যন্ত বৈঠকে গিয়েছিলেন অভিষেক। মমতার অনুরোধে বক্তৃতাও করেছিলেন। শুক্রবার মুর্শিদাবাদের জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে মমতা-সহ দলের অন্য নেতাদের বৈঠকেও যোগ দিয়েছিলেন অভিষেক। সেখানেও তিনি বক্তৃতা করেন। স্পষ্ট নিজের মতামতও ব্যক্ত করেন। তৃণমূলের অনেকেই বলছেন, সোমবার মমতা যদি অভিষেককে মিছিলে অংশ নিতে বলেন, তা হলে শারীরিক কোনও অপটুতা না-থাকলে ‘সেনাপতি’ নেত্রীর সঙ্গে পা মেলাতে পারেন।
মিছিলের প্রচার। —নিজস্ব চিত্র।
সম্প্রতি সমাজমাধ্যমে তৃণমূলের দলীয় পেজগুলির ‘কভার’ ছবিতে বদল আনা হয়েছে। তাতে মমতা-অভিষেকের ছবি দেখা যাচ্ছে। যা দেখে অনেকের ধারণা হয়েছিল, তৃণমূলের নেতাদের একাংশের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে যে ‘দূরত্ব’ লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, তা মিটে গিয়েছে। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, ‘শৈত্য’ এখনও পুরোপুরি কাটেনি। সেই প্রেক্ষিতেই তাঁরা সোমবারের মিছিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
বস্তুত, নবীন-প্রবীণ, বয়সবিধি ইত্যাদি সাংগঠনিক ‘মানদণ্ড’ নিয়ে তৃণমূলের সর্বোচ্চ স্তরে যে মতের বৈপরীত্য রয়েছে, তা গোপন নেই। বিষয়টি আরও বেআব্রু করে দিয়েছে দুই শিবিরভুক্ত নেতাদের লাগাতার মন্তব্য-তর্ক এবং প্রকাশ্য কাজিয়া। ফলে সূক্ষ্ম বিষয়গুলি যাঁদের নজর এড়িয়ে যাচ্ছিল, তাঁদের কাছেও ‘দ্বন্দ্ব’ ধরা পড়ছে। সেই আবহেই সোমবারের মিছিল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে শাসকদলের ঘরে।
সম্প্রতি মমতা যে ভাবে জেলা নেতৃত্বকে নিয়ে নিয়মিত বৈঠক শুরু করেছেন, তা দেখে অনেকেই বলছেন, প্রশাসনের পাশাপাশি সংগঠনের ‘রাশ’ মমতা নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের আগে থেকে এত দিন পর্যন্ত যা মূলত অভিষেকই করছিলেন। সেই কাজ হচ্ছিল পেশাদার ধাঁচে। ইদানীং সে সবও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। সেই পটভূমিকাতেই মমতা সোমবারের মিছিলের কথা ঘোষণা করেছেন। মিছিলের আগে তিনি কালীঘাটের মন্দিরে ‘একা’ গিয়ে পুজো দেবেন, এমনও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী।
এখন দেখার, সেই পুজোর পরে হাজরা থেকে যখন মিছিল শুরু হয়, তখন সেখানে অভিষেক থাকেন কি না। বস্তুত, ‘সেনাপতি’ থাকুন বা না-থাকুন, নেত্রীর সঙ্গে নজরে থাকবেন তিনিও। থাকলে তৃণমূল হাঁফ ছাড়বে। না-থাকলে আরও জোরালো হবে জল্পনা।