সোমবার মমতা বুদ্ধদেবকে দেখতে হাসপাতালে যান। অন্য দিকে, কুণালের আক্রমণ অব্যাহত। — ফাইল চিত্র।
গুরুতর অসুস্থ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সুস্থতা কামনা করলেও বাম জমানা নিয়ে আক্রমণাত্মক থাকছে তৃণমূল। একদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে নিয়মিত খোঁজ নিয়েছেন। সোমবার তিনি হাসপাতালে দেখতেও গিয়েছিলেন বুদ্ধদেবকে। অন্য দিকে, বুদ্ধদেবের জমানা নিয়ে লাগাতার রাজনৈতিক আক্রমণ করছেন তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। যেহেতু কুণাল তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র, তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে এটিই দলের ‘লাইন’। কিন্তু কেন অসুস্থ বুদ্ধদেব সম্পর্কে সহানুভূতি দেখানোর পাশাপাশি শাসক তৃণমূল তাঁকে এবং তাঁর জমানাকে আক্রমণের রাস্তায় যাচ্ছে?
শনিবার বুদ্ধদেব গুরুতর অসুস্থ হয়ে আলিপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সর্বস্তরে উদ্বেগ ছড়িয়েছিল। সেদিনই হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। রাতের দিকে হাসপাতালে যান রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তার আগে গিয়েছিলেন বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যও। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতার আগে তৃণমূলের প্রথম সারির কোনও নেতা বা নেত্রী বুদ্ধদেবকে দেখতে হাসপাতালে যাননি। সিপিএমের প্রথম সারির নেতারা অবশ্য শুরু থেকেই হাসপাতালে যাতায়াত করেছেন।
সাধারণত কোনও বড়মাপের নেতা বা নেত্রী গুরুতর অসুস্থ হলে তাঁকে দেখতে যান অন্যান্য দলের ওজনদার নেতানেত্রীরা। তার মধ্যে একটি বার্তাও নিহিত থাকে। ভেন্টিলেশনে-থাকা বুদ্ধদেবকে রবিবার দেখতে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বুদ্ধদেবকে দেখে বেরিয়ে বলেন, ‘‘বুদ্ধবাবুর মতো সৎ রাজনীতিক এই রাজ্যে আর আসেননি। এই রকম একজন সৎ রাজনীতিক বাংলার দলমত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধার।’’ ঠিক যেমন সুকান্ত বলেছিলেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে ওঁর রাজনীতির বিরোধিতা আছে। কিন্তু ওঁকে কেউ চোর বলবে না।’’
ঘটনাচক্রে, তার পর থেকেই বুদ্ধদেব এবং তাঁর শাসনকালকে রাজনৈতিক ভাবে আক্রমণ করতে শুরু করে তৃণমূল। বুদ্ধদেবের আরোগ্য কামনা করেও কুণাল বলেন, ‘‘ওঁকে মহাপুরুষ বানানোর চেষ্টা হচ্ছে।’’ বুদ্ধদেবকে নিয়ে ‘আদিখ্যেতা’ করা হচ্ছে, এমন মন্তব্যও করেন কুণাল। সিপিএমের নেতা-সমর্থকদের পাশাপাশি অনেকেই সমাজমাধ্যমে বুদ্ধদেব সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশংসাসূচক মন্তব্য করায় তার বিরোধিতা করে কুণাল ফেসবুকে লেখেন, ‘‘বুদ্ধবাবুর আরোগ্য আমিও চাই। উনি সুস্থ থাকুন। কিন্তু দয়া করে আদিখ্যেতার পোস্টে ওঁকে মহাপুরুষ বানাবেন না। উনি সিপিএম আর ওঁর ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভুলে বহু ক্ষতি হয়েছে।’’
সোমবার যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছেন, তখনও অন্য দিক থেকে রাজনৈতিক আক্রমণ জারি রেখেছেন কুণাল। একটি পথসভায় তিনি বুদ্ধেবের সঙ্গেই জ্যোতি বসুর আমলকেও টেনে এনে বলেছেন, ‘‘বুদ্ধদেববাবু সুস্থ হোন কামনা করি। কিন্তু সন্ত্রাসের কথা মনে করিয়ে দিতে হবে।’’ পাশাপাশিই মরিচঝাঁপি, সাঁইবাড়ি, নানুর, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, নেতাই, বানতলা প্রসঙ্গও টেনেছেন কুণাল।
তৃণমূলের অন্দরে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, এই ‘কৌশল’ পরিকল্পিত। দলের এক প্রথমসারির নেতার কথায়, ‘‘বুদ্ধবাবুকে অসাধারণ, অসামান্য ইত্যাদি বলার মধ্য দিয়ে আমাদের নেত্রীকে খাটো করার একটা রাজনীতি শুরু হয়েছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর অসুস্থতাকে সামনে রেখে সিপিএম এই রাজনীতি শুরু করেছে। ফলে আমাদেরও তার জবাব দিতে হচ্ছে। মানুষ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নিয়ে আমাদের কোনও বক্তব্য নেই। তাঁর দ্রুত সুস্থতা আমরা সকলেই কামনা করি। কিন্তু তাঁর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে যদি মুখ্যমন্ত্রীকে খারাপ দেখানো শুরু হয়, তা হলে আমাদেরও বুদ্ধবাবুর শাসনকাল মনে করিয়ে দিতে হবে।’’
প্রসঙ্গত, বিজেপির শুভেন্দু-সুকান্তেরাও একই ‘পথ’ নিয়েছেন। শুভেন্দু এবং সুকান্ত যে ভাবে বুদ্ধদেবের ‘সততা’র কথা বলেছেন, তাতে কারও নাম না-করলেও এটা স্পষ্ট যে, তাঁরা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কার সততার তুলনা করে কাকে বিঁধতে চাইছেন। তৃণমূল একই সঙ্গে বিজেপির ওই ‘কৌশল’-এরও মোকাবিলা করতে নেমেছে।
সোমবার মণিপুরের হিংসা নিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের একটি কর্মসূচিতে গিয়ে কুণাল বলেন, ‘‘প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দ্রুত আরোগ্য কামনা করব। কিন্তু আমরা প্রতি পদক্ষেপে মনে করিয়ে দেব, তাঁর জমানায় বাংলায় সন্ত্রাসের রাজত্ব চলেছিল। বাংলা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল। বাম জমানায় কয়েক প্রজন্ম ইংরেজি শিখতে পারেনি। অথচ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সিপিএম নেতাদের ছেলেমেয়েরা পড়েছে। ‘কম্পিউটার ঢুকতে দেব না’ বলে আন্দোলন করেছিল। বাংলা তথ্যপ্রযুক্তিতে পিছিয়ে গেল। ছেলেদের রক্তমাখা ভাত মা-বাবাদের খাওয়ানো হয়েছিল।’’
একই মঞ্চে কুণালের সঙ্গে ছিলেন তৃণমূল বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র, দলের প্রাক্তন সাংসদ অর্পিতা ঘোষ এবং কাউন্সিলর অরূপ চক্রবর্তী। মদনও বুদ্ধবাবুর জমানার সমালোচনা করেছেন। তবে তিনি পাশাপাশিই বলেছেন, ‘‘বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো শিরদাঁড়া আর কারও ছিল না।’’ কামারহাটির বিধায়ক মদন অবশ্য এখন সে ভাবে দলের ‘মূলস্রোতে’র অঙ্গ নন। অর্পিতা শুধু মণিপুর নিয়ে বক্তৃতা করেন। কুণালের মন্তব্য কি তাঁকে ‘অস্বস্তি’তে ফেলেছিল? অর্পিতা বলেন, ‘‘কুণালদার মন্তব্যের ব্যাখ্যা কুণালদা দেবেন। তবে অস্বস্তির কোনও কারণ নেই। কারণ, আজকের প্রজন্ম বাম জমানার কথা জানে না। এখন যাঁরা নতুন ভোটার, তাঁরা সেই সন্ত্রাস দেখেনি। তাই ব্যক্তি বুদ্ধদেববাবুর আরোগ্য কামনা করেও সেই সময়টা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার।’’ আর বুদ্ধদেব হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দিনই কাউন্সিলর অরূপ তাঁর ফেসবুক পেজ-এ লিখেছিলেন, ‘রাজনৈতিক ভাবে চিরকাল অপছন্দ করে এসেছি আপনাকে। আপনার রাজনীতিকে। কিন্তু সেটা রাজনৈতিক ক্ষেত্র। বয়ঃজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, আপনার দ্রুত সুস্থতা কামনা করি। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসুন জলদি।’ অর্থাৎ, ‘রাজনৈতিক সমালোচনা’ গোড়া থেকেই ছিল। সিপিএম এবং বিজেপির বুদ্ধ-স্তুতির মুখ তা আরও ধারাল করা হয়েছে শাসকদলের তরফে।
বস্তুত, কেউ যদি তাঁর মন্তব্যকে ‘অসৌজন্য’ বলে, তার জবাবও তৈরি করে রেখেছেন কুণাল। সোমবার তিনি বলেন, ‘‘বুদ্ধবাবুর সুস্থতা কামনা সকলে করছেন। আমরাও করছি। এতে তো কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু তা-ই বলে তিনি একজন মহাপুরুষ ছিলেন বলে পুজো করা ঠিক নয়। বুদ্ধদেববাবু সুস্থ হোন। কিন্তু সন্ত্রাসের কথা নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে দিতে হবে।’’ কুণালের বক্তব্য, ‘‘কেউ যদি অসৌজন্যের কথা বলেন, তাঁদের মনে করাব, পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে গিয়ে (হেলিকপ্টার দুর্বিপাকে) আমাদের নেত্রী যখন পায়ে চোট পেয়েছিলেন, তখন তাঁরা কোথায় ছিলেন? কোন বিরোধীদলের কোন নেতা সৌজন্য দেখিয়েছিল? সিপিএম তো চূড়ান্ত অসৌজন্য দেখিয়ে মিম বানাতে ব্যস্ত ছিল!’’
লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে শূন্যে পৌঁছে গেলেও সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিএমের ভোট বেড়েছে। অনেকের মতে, অশক্ত এবং অসুস্থ হয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেক দূরে থাকলেও এখনও সিপিএমের মধ্যে ‘বিগ্রহ’ বলতে বুদ্ধদেবই। তাঁর অসুস্থতাকে সামনে রেখে আবেগ তৈরি করে মূলত নেটমাধ্যমে ‘সহানুভূতি’ আদায় করতে চাইছেন সিপিএম সমর্থকদের একাংশ। তেমনই জানিয়েছেন তৃণমূলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাঁর কথায়, ‘‘বুদ্ধদেববাবুর অসুস্থতা নিয়ে রাজনীতি তো করছে সিপিএম! আমরা তারই জবাব দিচ্ছি মাত্র।’’