বনগাঁয় বিক্ষোভ সমাবেশে বিমান বসু। —নিজস্ব চিত্র।
লক্ষ্য একই। তবু পথ পৃথক!
নয়া নাগরিকত্ব আইন এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) বিরোধিতায় পথে নেমেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই কারণে পথে বাম ও কংগ্রেসও। তবু এক যাত্রায় কেন পৃথক ফল? সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও অশান্তি রুখতে কেন মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসক পক্ষের সঙ্গে একত্রে পথে দেখা যাচ্ছে না বাম ও কংগ্রেসকে? বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও শাসক পক্ষের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসতে অস্বীকার করে বিরোধীরা কি অন্য কোনও পক্ষের সুবিধা করে দিচ্ছে না— এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে নানা মহলে।
কেরলে সাবেক বিরোধিতার ইতিহাস পাশে সরিয়ে নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে সোমবারই তিরুঅনন্তপুরমে একসঙ্গে সত্যাগ্রহ অবস্থানে বসেছেন বাম-শাসিত সরকারের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন ও বিরোধী দলনেতা, কংগ্রেসের রমেশ চেন্নিথালা। তার পরেই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলায় মুখ্যমন্ত্রীর দলের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কেন শান্তিরক্ষা ও বিভাজনের রাজনীতি বন্ধ করার আবেদন করছেন না বাম ও কংগ্রেস নেতারা? কেনই বা তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে প্রস্তাব দিচ্ছেন না প্রয়োজনে পতাকা ছেড়ে একত্রে পথে নামার?
আরও পড়ুন: কলকাতায় গ্রেফতার এমআইএম শীর্ষ নেতা, ধরপাকড় জেলাতেও
প্রদেশ কংগ্রেস ও বাম নেতাদের যুক্তি, কেরল আর বাংলার পরিস্থিতি এক নয়। তবে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে সর্বদল বৈঠক ডাকার আবেদন জানাচ্ছেন। পরিস্থিতির প্রয়োজনে সেখানে যা সিদ্ধান্ত হবে, তা মেনে নেওয়ার কথা বলছেন তাঁরা। বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের নরেন চট্টোপাধ্যায়, হাফিজ আলম সৈরানি, ডলি রায়েরা এ দিন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে দেখা করেও সর্বদল বৈঠকের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে এসেছেন। বাম ও কংগ্রেসের আশঙ্কা, এনআরসি বা নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতার জন্য তারা তৃণমূলের পাশে দাঁড়িয়ে গেলে বিজেপির পক্ষে এ রাজ্যে মেরুকরণ করতে আরও সুবিধা হবে!
রাজারহাট নিউটাউনে বামেদের মিছিল। —নিজস্ব চিত্র।
এনআরসি এবং নাগরিকত্ব আইনের ভিত রয়েছে অনুপ্রবেশকারী-বিতর্কে। তৃণমূল সাংসদ হিসেবে মমতা এক সময় অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে স্পিকারের আসনের দিকে কাগজ ছুঁড়েছিলেন, সেই ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছেন বাম ও কংগ্রেস নেতারা। বাবরি ধ্বংস বা গুজরাত দাঙ্গার পরেও বিজেপির শরিক হয়ে এনডিএ সরকারে থাকার ইতিহাসও তাঁরা টানছেন। কিন্তু সে সব সরিয়ে নির্দিষ্ট একটা প্রশ্নে কি এক বিন্দুতে আসা যায় না? বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীর মতে, ‘‘সমস্যাটা তৃণমূলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। এনআরসি-র বিরুদ্ধে একসঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব বিধানসভায় আমরা তো দিয়েছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী যখন এনআরসি-র বিরোধিতা করছিলেন, তখনই এনপিআর-এর জন্য সরকারি প্রশিক্ষণ চলছিল। এখন বাতিল হল। এই আহাম্মকপনার কি দরকার ছিল? তৃণমূল কখন কী করবে, সেই দোলাচলের সঙ্গে নিজেদের জড়াব কী ভাবে?’’ নাগরিকত্ব বিল পাশ হওয়ার পরে রাজ্যে কয়েক দিনের প্রতিবাদ প্রসঙ্গে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘যা করার, তা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে করতে হবে। এমন কিছু করবেন না, যাতে আপনার শত্রুর হাত শক্তিশালী হয়।’’
প্রদেশ কংগ্রেসের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘এখন দেশ ও সংবিধান বাঁচানোর লড়াই। শুধু মিছিল করে হবে না, মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন, পরিস্থিতির বিচারে দ্রুত সর্বদল বৈঠক ডাকুন।’’ প্রয়োজনে তাঁরা ওই আর্জি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিও দেবেন।
তৃণমূলের সঙ্গে এক রাস্তায় মিলিত না হওয়ায় এ দিন নিউটাউন ও বনগাঁয় আলাদা করেই বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বামেরা। দু’জায়গাতেই ভিড় হয়েছিল ভাল। নাগরিকত্ব আইনের পাশাপাশি ডিটেনশন সেন্টারের জন্য জমি দেওয়ার পরিকল্পনার প্রতিবাদে নিউটাউনের কর্মসূচিতে ছিলেন সুজনবাবু, মানস মুখোপাধ্যায়, বনগাঁয় ছিলেন বিমান বসু। আইনের প্রতিলিপি পুড়িয়ে অন্তত ৬০০ জায়গায় বিক্ষোভ করেছে এসএফআই-সহ বাম ছাত্র সংগঠনগুলি। তীব্রতা আরও বাড়াতে সব প্রতিবাদ এক জায়গায় এল না কেন, সে প্রশ্ন তবু থেকেই যাচ্ছে!