Sougata Roy

কেকে-পার্থ-সিঙ্গুর, সব বিষয়ে ‘রায়’, সৌগত কি পালাবদলের পালায় তৃণমূলের ‘বিবেক’?

সৌগত রায় প্রাক্তন অধ্যাপক। সৌগত রায় ১৯৭৭ সালে প্রথম বার সাংসদ। পাঁচ বারের বিধায়ক। দমদম থেকে টানা তিন বারের সাংসদ। পাশাপাশি তিনি কি ‘তৃণমূলের বিবেক’-ও?

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৪২
Share:

সৌগত কি তৃণমূলের ‘বিবেক’ হয়ে উঠেছেন? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

দীর্ঘ দিন ধরে তাঁর একটিই কলার টিউন— ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়...।’ সাধারণত কলার টিউন শেষ হওয়ার আগেই ফোন ধরে নেন সৌগত রায়। তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ যে কোনও বিষয়ে তাঁর মতামত চাইলে সাংবাদিকদের ফেরান না। অনেক সময় তাঁর মন্তব্য নিয়ে দলকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। আবার অনেকে মনে করেন, সৌগত যা বলছেন, তাতে দলের ভালই হচ্ছে। কারণ, তিনি ‘সত্যি কথা’টা প্রকাশ্যে বলছেন।

Advertisement

যেমন তিনি বলেছেন বুধবারেও। জানিয়েছেন, তিনি মনে করেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় দলের ‘বিড়ম্বনা’র কারণ হলেও অনুব্রত মণ্ডল বা মানিক ভট্টাচার্য তা নন। সৌগত বলেছেন, ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে স্তূপীকৃত নগদ টাকা উদ্ধার হতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু মানিকের ক্ষেত্রে টাকা পাওয়া যায়নি। অনুব্রতের ক্ষেত্রেও মোটা পরিমাণ টাকা দেখা যায়নি।’’

তৃণমূলে সৌগতর এই ‘হাজির জবাব’ ভূমিকা নিয়ে নানা মত আছে। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ তাঁকে কিছু বলেন না। এক বারই সৌগত যখন বিরোধীদের ‘পিঠে তাল পড়া’র হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, তখন কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে বলতে হয়েছিল, তৃণমূল ‘গান্ধীবাদী দল’। বিরোধীদের উপর হামলার রাজনীতিতে তারা বিশ্বাস করে না। তার পরেও সৌগত বলেছিলেন, ‘‘সমালোচকদের গায়ের চামড়া দিয়ে তৃণমূলের পায়ের জুতো তৈরি হবে।’’ কেন বলেছিলেন? আনন্দবাজার অনলাইনকে সৌগত বলেছিলেন, ‘‘আমি মনে করছি বিজেপিকে একটু ঠান্ডা রাখা দরকার। ওরা বড্ড বেশি বলছে। তাই এমন ভাষা।’’

Advertisement

কিন্তু তাঁকে তো সচরাচর এমন ভাষা ব্যবহার করতে দেখা যায় না! সৌগত পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘সব ভাষাই আনন্দবাজার অনলাইনের মতো সুশব্দ হবে, এমন কি কোনও কথা আছে? ভাষার উপর আমার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। যখন যেমন দরকার পড়বে, তখন তেমন ভাষায় বলব।’’

অনেকে মনে করেন, সৌগত আসলে ‘তৃণমূলের বিবেক’। তিনি নিজেও কি তাই মনে করেন? সৌগতকে প্রশ্ন করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। শুনে খানিক উষ্মাই প্রকাশ করেছেন প্রাক্তন অধ্যাপক। বলেছেন, ‘‘আমার অত ঔদ্ধত্য নেই!’’

কিন্তু তাঁর হালফিলের অন্তত তিনটি মন্তব্য বলছে, সৌগতকে ‘বিবেক’-এর ভূমিকায় দিব্যি মানিয়ে যায়। প্রথমটি বলিউডের নেপথ্যগায়ক কেকে-র মৃত্যু নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে। নজরুল মঞ্চে এক অনুষ্ঠানের পরেই মৃত্যু হয়েছিল কেকে-র। তৃণমূল‌ের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে খরচ হওয়া টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সৌগত। সেই সংগঠনেরই এক কর্মসূচিতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমি শুধু ভাবি যে, এত টাকা কোথা থেকে এল! ৩০ লাখ না ৫০ লাখ কত যেন লেগেছে শুনলাম! টাকা তো হাওয়া থেকে আসে না। এই রকম প্রচণ্ড খরচ করে বম্বে থেকে শিল্পী আনার কি খুব দরকার ছিল? এত টাকা দিয়ে এ সব করতে গেলে কারও না কারও কাছে সারেন্ডার করতে হয়। এলাকার মস্তান নয়তো প্রোমোটারের কাছে। প্রথমেই যদি সারেন্ডার করো, তা হলে বাকি জীবন লড়াই করবে কী করে?”

দ্বিতীয়— প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি প্রসঙ্গে। সৌগত বলেছিলেন, ‘‘সারা ভারতেই এমন দুর্নীতির ব্যাপার কম হয়েছে। বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ অনেক দিন জেলে ছিলেন। কিন্তু লালুর কাছ থেকে এত নোট তো বার হয়নি! কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন সুখরাম। তাঁর ওখান থেকে দু-তিন-চার কোটি টাকা উদ্ধার হচ্ছে দেখা গিয়েছে। এই ভাবে তো কোথাও কখনও দেখা যায়নি!’’

গায়ক কেকে-র মৃত্যুর পরে দলের অস্বস্তি বাড়িয়েছিল সৌগতর মন্তব্য। ফাইল চিত্র।

পার্থ-কাণ্ডে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ জহর সরকার যখন দলকে আক্রমণ করেছিলেন, তখন আবার পাল্টা হামলা করেছিলেন ‘তৃণমূলের বিবেক’। বলেছিলেন, ‘‘জহর সরকার যে স্বার্থপর এবং স্বার্থকেন্দ্রিক, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই ধরনের আমলারা এমনই হন। এঁরা উপকার নেন। তার পরে ক্ষতি করার আগে এক বারও ভাবেন না। পারলে উনি সাংসদ পদ আর সে বাবদে পাওয়া সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে দিন!’’

তৃতীয় মন্তব্য গত সপ্তাহে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক মন্তব্যের জেরে সিঙ্গুর আবার খবরে। সেই আবহে সংবাদমাধ্যমকে সৌগত বলেছেন, ‘‘যাঁরা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদেরই প্রথম সারিতে থাকা উচিত। ২০০৯ সাল থেকে থাকা কর্মীরা কিছু পাওয়ার আশায় দল করতেন না। তাঁদের মধ্যে নিষ্ঠা অনেক বেশি ছিল। পরে হড়পা বানের মতো দলে লোক ঢুকেছে। তার নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। নতুনরা এসেছেন বলে পুরনোদের পিছনের সারিতে রাখা চলবে না।’’

পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার হওয়ার পরে বার বার সরব হয়েছেন সৌগত। ফাইল চিত্র।

সৌগত নিজে তৃণমূলের পুরনো দিনেরই সঙ্গী। সেন্ট লরেন্স হাই স্কুল থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যার ছাত্র। পরে সেই বিষয়েরই অধ্যাপক আশুতোষ কলেজের। তার আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়েও পড়াশোনা করেন। রাজনীতিতে এসেছেন সেই সত্তরের দশকে। পাঁচ বারের বিধায়ক। তিন বার আলিপুর, ঢাকুরিয়া এবং বনগাঁ থেকে এক বার করে। প্রথম বার সাংসদ হয়েছিলেন সেই ১৯৭৭ সালে ব্যারাকপুর থেকে কংগ্রেসের টিকিটে। তৃণমূলের সাংসদ হয়েছেন দমদম থেকে টানা তিন বার। ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে।

তাঁর এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতার নিরিখে সৌগত কি সত্যিই দলের ‘বিবেক’?

তাঁর লোকসভা এলাকার বিধায়ক তথা রাজ্যের এক মন্ত্রী বলছেন, ‘‘সৌগতদার বয়স হয়েছে। বয়স হলে মানুষ একটু বেশি কথা বলে। মাঝেমাঝে উনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। দলকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। অন্য কেউ হলে হয়তো নেত্রীর বকুনি শুনতে হত। কিন্তু প্রবীণ বলে সৌগতদা ছাড় পেয়ে যান।’’ দলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলের বিভিন্ন বিষয়ে যেটা বলেন, সেটাই ওঁর মত। আমার মনে হয় না উনি দলকে অস্বস্তিতে ফেলেন।’’ আর অপর মুখপাত্র তাপস রায়ের কথায়, ‘‘সৌগতদা তো ভুল কিছু বলছেন না! প্রবীণ-নবীন প্রসঙ্গে যা বলেছেন, সেটা তো ঠিকই। দলে যেমন সব সময় নবীন শক্তি আসার স্রোত থাকা দরকার, তেমনই প্রবীণদের থেকে শেখাটাও চালিয়ে যাওয়া উচিত। প্রবীণ-নবীনের যৌথ চেষ্টাতেই তো দল এগোবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement