Abhishek Banerjee

বার বার ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যেই অভিষেককে তলব করে কি ‘গুরুত্ব’ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে? দুশ্চিন্তায় পদ্ম

আবার অভিষেককে তলব করেছে ইডি। অতীতের মতো এ বারেও এমন দিনে তাঁকে তলব করা হয়েছে, যা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। গেরুয়া শিবিরের চিন্তা, কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা আসলে অভিষেকের সুবিধাই করে দিচ্ছেন না তো!

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২১:০২
Share:

‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ কর্মসূচির মধ্যেও দু’বার ডাক পেয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।

যত বার তৃণমূলের ঘোষিত কর্মসূচি, তত বারই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তলব অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। প্রতি বার দীর্ঘ এবং টানা জেরা। তার পরে বেরিয়ে এসে তৃণমূলের ‘সেনাপতি’র কড়া ভাষায় কেন্দ্রীয় সরকার এবং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে আক্রমণ। গত বেশ কয়েক মাস ধরে এটাই রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং প্রতিটি জেরার পরেই ‘রাজনৈতিক গুরুত্ব’ বেড়ে যাচ্ছে তৃণমূলের সাংসদ তথা সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের। প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে তৃণমূলের ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’র তত্ত্ব। সেই তালিকায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন ৩ অক্টোবর ইডির তলব।

Advertisement

ইডির চিঠি অনুযায়ী ৩ তারিখ, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় অভিষেক হাজিরা দেবেন কি না, তা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। অনেকে বলছেন, তিনি তখন পূর্বঘোষিত দলীয় কর্মসূচিতে দিল্লিতে থাকবেন। ফলে তিনি ওই তলবে সাড়া দেবেন না। কর্মসূচির পরে কোনও এক দিন যাবেন বলে ইডিকে জানাবেন। আবার অনেকে বলছেন, দিল্লিতে কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে অভিষেককে তলব করা হয়েছে। ফলে প্রথম দিনের কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার পরে দ্বিতীয় দিন তিনি কলকাতায় হাজিরা দিতেও পারেন। তবে অভিষেক না গেলে তিনি ইডিকে তা চিঠি দিয়ে জানাবেন বলেই তৃণমূল সূত্রের খবর।

সোম এবং মঙ্গলবার (২ এবং ৩ অক্টোবর) দিল্লিতে তৃণমূলের কর্মসূচি। ওই কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেবেন অভিষেক। কারণ, পায়ে চোট পাওয়ার কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই কর্মসূচিতে যাওয়া অনিশ্চিত। রাজ্যের বকেয়া পাওনা কেন্দ্রের থেকে আদায়ের দাবিতে দিল্লি অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক। সেই ঘোষিত কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে ইডি।

Advertisement

এর আগেও একাধিক বার অভিষেককে ইডি বা সিবিআই তলব করেছিল তাঁর ঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচির দিনেই। কখনও তাঁর ‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ কর্মসূচি চলাকালীন। কখনও ‘ইন্ডিয়া’র সমন্বয় কমিটির বৈঠকের দিন। আর এ বার তাঁর কেন্দ্র-বিরোধী কর্মসূচির সময়।

১৩ সেপ্টেম্বর জিজ্ঞাসাবাদের পরে সংবাদমাধ্যমের সামনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।

প্রত্যাশিত ভাবেই শেষ তলবটি নিয়ে অভিষেক স্বয়ং প্রশ্ন তুলেছেন। একযোগে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে তৃণমূলও। আর ‘বিড়ম্বনা’য় পড়েছে বিজেপি। একান্ত আলোচনায় রাজ্য বিজেপির প্রথম সারির নেতাদের একটি অংশ স্বীকারও করে নিচ্ছেন যে, এ ভাবে বার বার অভিষেকের ‘রাজনৈতিক গুরুত্ব’ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। দলের এক শীর্ষনেতার কথায়, ‘‘এ ভাবেই তো ওঁকে নেতা বানিয়ে দেওয়া হল!’’

‘দুশ্চিন্তাগ্রস্ত’ বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে অন্য কথা বললেও দলের অন্দরে আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন, এই ভাবে অভিষেককে আরও বেশি করে প্রচারে নিয়ে আসছে ইডি-সিবিআই। প্রতি বারই অভিষেকের জন্য প্রচারের ‘মঞ্চ’ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। অনেকের মতে, তলবের দিন বাছাই নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে যে প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে, সেই প্রশ্নটি কি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা বা কেন্দ্রীয় বিজেপির নেতারা বুঝতে পারছেন না?

বিজেপির রাজ্য মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘একই দৃশ্য বার বার দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। আমাদের অভিধানে এই মুহূর্তে কোনও ভাষা নেই। সবই হচ্ছে আদালতের কথায়।’’ তবে পাশাপাশিই বিষয়টিকে খানিক ‘লঘু’ করার চেষ্টায় শমীক বলেছেন, ‘‘জিজ্ঞাসাবাদের শেষে আবার দেড় ঘণ্টার সাংবাদিক বৈঠক হবে। আমরা চিন্তিত সাংবাদিকদের নিয়ে। অত রাতে অত লম্বা সাংবাদিক বৈঠক শেষে অল্পবয়সিদের অনেকেরই বাড়ি ফেরার অসুবিধা হয়।’’

প্রত্যাশিত ভাবেই সিপিএম সাংসদ তথা আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য অভিষেকের বিরুদ্ধে গিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ইডি তো তদন্তকারী সংস্থা! তারা কি জেনে বসে থাকবে যে কবে তৃণমূলের কর্মসূচি রয়েছে? অভিষেককে ওই দিন যাতে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়, তা ইডিকে নিশ্চিত করতে হবে। তৃণমূলের আর কি নেতা নেই, যে অভিষেককে ছাড়া কর্মসূচি হবে না?’’

তবে ঘোষিত কর্মসূচির দিন অভিষেককে তলব করার ‘ধারাবাহিকতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করে দিয়েছে তৃণমূল। দলের মুখপাত্র তথা রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘অভিষেকের একটা কর্মসূচি থাকলেই তাঁকে এজেন্সি ডেকে পাঠাচ্ছে। তাঁকে বিরক্ত করা আর উত্ত্যক্ত করা এখনও ওদের একটা কাজ।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘কেন্দ্র প্রতিহিংসাপরায়ণতার রাজনীতি করছে। অভিষেক বাংলার বকেয়া টাকা আনার জন্য যাচ্ছেন। ঠিক সেই দিন ডাক। এটাই তো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রমাণ।’’ রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ ভৌমিকের কথায়, ‘‘তৃণমূলের রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলেই অভিষেককে তলব করা হয়। এ বারেও তাই হয়েছে। এই ঘটনা আরও বেশি করে প্রমাণ করে দিল, কী ভাবে ইডি, সিবিআইকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করা হচ্ছে।’’ কুণাল, পার্থেরা মনে করিয়ে দিয়েছেন আগের তিনটি তলবের উদাহরণের কথা। অভিষেক তার মধ্যে দু’বার হাজিরা দিয়েছিলেন। এক বার দেননি। দেবেন যে না, তা চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন নির্ধারিত দিনের আগেই।

গত ২০ মে ‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ কর্মসূচি চলাকালীন অভিষেককে তলব করে সিবিআই। তখন তিনি ছিলেন বাঁকুড়ায়। ১৯ মে তাঁকে জানানো হয় পর দিনই হাজিরা দিতে হবে। সেই তলবে হাজিরা দিয়েছিলেন অভিষেক। কিন্তু তার আগে চোখা ভাষায় নিজের রাজনৈতিক বক্তব্য জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘ওদের কাছে আমি মাথা নিচু করিনি। আমি মাথা নিচু করব মানুষের কাছে, বাবা-মায়ের কাছে, দলনেত্রীর কাছে। কিন্তু দিল্লির বহিরাগতদের কাছে মাথা নত করব না!’’ অভিষেকের অনুপস্থিতিতে বাঁকুড়ায় অভিষেকের পূর্বঘোষিত সভায় কলকাতা থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে ভাষণ দিয়েছিলেন মমতা। বলেছিলেন, ‘‘অভিষেককে বিজেপি ভয় পায়। বিজেপির কাছে মাথা নত করব না। তর্জন-গর্জন করে আমাদের দমানো যাবে না। বিজেপিকে দেশ ছাড়া না করা পর্যন্ত লড়াই চলবে।’’

পরদিন দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পরে সংবাদমাধ্যমকে অভিষেক বলেছিলেন, ‘‘তদন্তের নামে জনসংযোগ যাত্রাকে বাধা দেওয়া ও ভাঙার জন্য এটি একটি ধারাবাহিক, মজ্জাগত, সুপরিকল্পিত অভিসন্ধি। রাজনৈতিক দলের নির্দেশে এই কাজগুলি হচ্ছে।’’

গত ১৩ জুলাই ‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ কর্মসূচির শেষ পর্বে অভিষেককে তলব করে ইডি। সে বার অভিষেক সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দেন, সাড়া দেবেন না। পরে তা ইডিকে ১৫ পাতার চিঠি পাঠিয়ে জানান, ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচিতে তিনি কলকাতার বাইরে। পঞ্চায়েত ভোটের জন্য ব্যস্ত রয়েছেন। ভোট শেষের পর হাজিরা দিতে পারেন।

তৃতীয় বার অভিষেককে তলব করা হয় গত ১৩ সেপ্টেম্বর। সে দিন ছিল বিজেপি বিরোধী জোটের সমন্বয় কমিটির প্রথম বৈঠক। দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া’-র সেই বৈঠকে কমিটির সদস্য হিসাবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল অভিষেকের। কিন্তু তার তিন দিন আগে আসে ইডির সমন। দেখা যায়, ওই দিনই তাঁকে হাজিরা দেওয়ার জন্য নোটিস পাঠানো হয়েছে। অভিষেক ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে না গিয়ে জেরার মুখোমুখি হন। শরদ পাওয়ারের দিল্লির বাড়িতে বিরোধীদের বৈঠকে কেন্দ্রের প্রতিহিংসার রাজনীতির অভিযোগকে চিহ্নিত করতে অভিষেকের চেয়ারটি ফাঁকা রাখা হয়েছিল। যার ফলে জাতীয় রাজনীতিতে আরও বেশি করে আলোচিত হয়েছিল অভিষেকের নাম।

প্রতিবারেই জেরার পর বেরিয়ে অভিষেক কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে তুলোধনা করেছেন। কখনও বলেছেন, ‘‘অশ্বডিম্ব প্রসব হল!’’ কখনও বলেছেন, ‘‘ইডিকে এ বার মাইনস টু নম্বর দিলাম।’’ তিনি যত কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে হেয় করেছেন, ততই হতাশা বেড়েছে রাজ্যের পদ্মশিবিরের। সেই সূত্রেই রাজ্যে বিজেপি নেতাদের একাংশের বক্তব্য, আরও এক বার অভিষেকের ঘোষিত কর্মসূচির সময় তাঁকে তলব করে আবার তাঁর ‘রাজনৈতিক গুরুত্ব’ বাড়িয়ে দিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement