Lok Sabha Election 2024

বাংলায় ৩৫ আসন জেতা নাকি মোটেই কঠিন নয়! ৪২টি আসনকে পাঁচ ভাগ করে অঙ্ক তৈরি বিজেপির

সম্প্রতি রাজ্য সফরে এসে অমিত শাহ বলে গিয়েছেন, বাংলা থেকে কমপক্ষে ৩৫টি আসন চাই আগামী লোকসভা নির্বাচনে। কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব গেরুয়া শিবিরের পক্ষে! যদিও অঙ্ক একটা রয়েছে বিজেপির।

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৩ ১১:২৭
Share:

আপাতত রাজ্য বিজেপির নতুন স্লোগান— ‘অব কি বার, ৩৫ পার।’ গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ ।

বাংলা থেকে ৩৫ আসনে জয় পাওয়া খুব একটা কঠিন হবে না। এমনটাই মনে করেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এখন থেকে লোকসভা নির্বাচনের জন্য ঝাঁপিয়ে-পড়া বিজেপি ইতিমধ্যেই রাজ্যের ৪২টি আসনকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। তার উপরে ভিত্তি করেই লড়াইয়ের পরিকল্পনা। সেই ভাগ মূলত করা হয়েছে আসনগুলিতে অতীতে বিজেপির ভোটপ্রাপ্তির উপরে নির্ভর করে। তাতেই বিজেপির অঙ্ক— রাজ্যে ১৭টি আসন বিজেপির কাছে ‘সহজতম’। আরও ১৭টি ‘সহজতর’। এর পরেও ‘সহজ’, ‘কঠিন’ এবং ‘অতি কঠিন’ ভাগ রয়েছে। ‘সহজতম’, ‘সহজতর’ আসনগুলির সঙ্গে আরও একটি যোগ করতে পারলেই ৩৫ হয়ে যাবে বলে বিজেপি নেতৃত্বের আশা। এই হিসাব নিয়ে এখনই কেন্দ্রীয় বা রাজ্য স্তরের বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও সেই মতো প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে বলে গেরুয়া শিবির সূত্রে দাবি।

Advertisement

ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে ১৯৮৪ সালে যে লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল, তাতে কংগ্রেস ৪০৪টি আসনে জয় পেয়েছিল। ভারতের ইতিহাসে সেটাই সবচেয়ে বেশি শক্তি নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার নজির। এর পরে দ্বিতীয় জায়গায় রয়েছে ২০১৯ সালের ফল। যখন ৩০৩ আসনে জয় পেয়ে দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদী। এখন বিজেপির লক্ষ্য, ১৯৮৪ সালে ক‌ংগ্রেস যে ফল করেছে তা টপকে যাওয়া। সেই কারণেই এখন থেকে বিজেপি স্লোগান তুলতে শুরু করেছে— ‘অব কি বার, চারশো পার’।

সেই লক্ষ্যে ২০২২ সাল থেকেই ২০২৪ সালের ভোটের প্রস্তুতি শুরু করে দেয় বিজেপি। গোটা দেশেই হেরে যাওয়া আসনগুলির লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। প্রত্যেক রাজ্যকেই ‘টার্গেট’ ঠিক করে দিয়েছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। কিন্তু বিজেপির খাতায় ‘শক্তিশালী’ রাজ্যগুলিতে আসন বাড়ানোর সুযোগ নেই বললেই চলে। দেশের সবচেয়ে বেশি আসনের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে ৮০টির মধ্যে ২০১৯ সালে বিজেপি জোট জিতেছিল ৬৪টি আসনে। পরে আজমগড় আসনে উপনির্বাচনে জেতায় যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে গেরুয়া শিবিরের সাংসদ সংখ্যা এখন ৬৫। অন্য দিকে, বিজেপির গড় গুজরাতে ২৬টি আসনের মধ্যে সব ক’টিই তাদের দখলে।

Advertisement

এই পরিস্থিতিতে বিজেপির বেশি নজর কম শক্তি থাকা রাজ্যগুলির দিকে। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম। সম্প্রতি বীরভূমের সিউড়ির সমাবেশ থেকে শাহ লক্ষ্য বেঁধে দিয়ে গিয়েছেন রাজ্য বিজেপিকে। বাংলা থেকে কমপক্ষে ৩৫টি আসন জিততেই হবে!

বিজেপির অঙ্ক— রাজ্যে ১৭টি আসন বিজেপির কাছে ‘সহজতম’। আরও ১৭টি ‘সহজতর’। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

কিন্তু কিসের ভিত্তিতে এই স্বপ্ন? বিজেপি হিসাব করে দেখেছে, গত লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় যে ক’টি আসনে জয় এসেছিল, তার মধ্যে ব্যারাকপুর ও রায়গঞ্জ বাদ দিলে বাকি ১৬টিতে ৪৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল তারা। ব্যারাকপুরে পেয়েছিল ৪৩.৩ এবং রায়গঞ্জে ৪০.৫ শতাংশ। সেই হিসাবে বিজেপির অঙ্ক অনুযায়ী কোনও আসনে কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ ভোট পেলেই জয় নিশ্চিত।

এই অঙ্কের উপরে নির্ভর করে বিজেপি প্রতিটি আসন ধরে হিসাব কষেছে। তাতে দেখা গিয়েছে ১৭টি আসনে জয় সহজতম। সেগুলি হল— দার্জিলিং, আলিপুরদুয়ার, রানাঘাট, আসানসোল, জলপাইগুড়ি, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, কোচবিহার, বনগাঁ, মেদিনীপুর, কাঁথি, বিষ্ণুপুর, হুগলি, আরামবাগ, তমলুক, বালুরঘাট, ঝাড়গ্রাম। এর মধ্যে বিজেপি পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি আসনে ২০১৯ সালে পেয়েছিল ৪২.৪ শতাংশ ভোট। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে তাদের প্রাপ্তি ৪৮.৭ শতাংশ ভোট। আবার আরামবাগ আসনে বিজেপি হেরে গেলেও পেয়েছিল ৪৪.৭ শতাংশ ভোট। হারের ব্যবধান ছিল ১,১৪২ ভোট। কিন্তু গত বিধানসভা নির্বাচনে এই এলাকার চারটি বিধানসভায় জেতায় আরামবাগে ৪৬.২ শতাংশ ভোটপ্রাপ্তি। তবে উল্টো ছবিও রয়েছে। গত আসানসোল উপনির্বাচনে বিজেপি পায় ৩০.৪৬ শতাংশ ভোট। কিন্তু অতীতে দল সর্বোচ্চ ৫১.৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।

দ্বিতীয় ভাগেও রয়েছে ১৭টি আসন। ব্যারাকপুর, ঘাটাল, বর্ধমান দুর্গাপুর, বোলপুর, রায়গঞ্জ, কৃষ্ণনগর, বর্ধমান পূর্ব, বীরভূম, বারাসত, শ্রীরামপুর, হাওড়া, দমদম, উলুবেড়িয়া, মালদহ উত্তর, মথুরাপুর, কলকাতা উত্তর, কলকাতা দক্ষিণ। এই আসনগুলির মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ব্যারাকপুর এবং রায়গঞ্জে। ভোটপ্রাপ্তি ছিল ৪৩.৩ এবং ৪০.৫ শতাংশ। ৪৫ শতাংশের নীচে থাকায় এগুলি ‘সহজতর’ আসনের তালিকায়। গত লোকসভা নির্বাচনে রায়গঞ্জে বিজেপি জয় পেয়েছিল মূলত ভোট কাটাকাটির অঙ্কে। কংগ্রেস প্রার্থী দীপা দাশমুন্সি এবং সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিম অনেকটা ভোট কেটে নেওয়ায় বিজেপির দেবশ্রী চৌধুরী জয় পান। এ বারে ভোট কাটাকাটির অঙ্ক একই থাকবে না ধরে নিয়ে বিজেপির লক্ষ্য এই আসনে নিজস্ব প্রাপ্তি ৪৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া।

এই ৩৪টি আসনের পরেও বিজেপি ‘সহজ’ আসনের তালিকায় রেখেছে মালদহ দক্ষিণ, ডায়মন্ড হারবার (অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্র), জয়নগর, বহরমপুর, বসিরহাটকে। এই আসনগুলিতে বিজেপি অতীতে ভোট পেয়েছে ৩৫ শতাংশের কম কিন্তু ৩০ শতাংশের বেশি। আর ‘কঠিন’ আসনের তালিকায় মাত্র একটি— যাদবপুর। অতীতে বিজেপি এখানও সর্বোচ্চ ২৮.৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে। কিন্তু এখন নতুন একটি অঙ্ক রয়েছে বিজেপির। এই লোকসভা আসনের অন্তর্গত ভাঙড় আসনে গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল হেরেছে। দলের অঙ্ক সংখ্যালঘু গোটা লোকসভা এলাকাতেই বাক্সবদল করলে তার সুফল পেতে পারে বিজেপি। তবে বিজেপি একেবারেই আশাবাদী নয় জঙ্গিপুর এবং মুর্শিদাবাদ আসন নিয়ে। এই দু’টি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত আসনে বিজেপি অতীতে সর্বোচ্চ ২৪.৫ এবং ১৮.৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।

রাজ্য নেতারা কেউই অবশ্য প্রকাশ্যে এই হিসাব নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বিজেপির এই ভোটের অঙ্কের মধ্যে মাথায় রাখা হয়েছে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি ভোটের ফলও। ওই আসনে তৃণমূলের হারের পিছনে অন্যতম কারণ হিসাবে মনে করা হচ্ছে সংখ্যালঘু ভোটের বড় অংশ শাসকদলের বিরুদ্ধে যাওয়া। সেই অঙ্ক রাজ্যের অনেক জায়গায় গেরুয়া শিবিরকে বাড়তি সুবিধা করে দিতে পারে বলেই মনে করছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

রাজ্য নেতারা কেউই অবশ্য প্রকাশ্যে এই হিসাব নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। তবে এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, ‘‘উত্তরবঙ্গে তো বটেই, দক্ষিণবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে আমাদের শক্তি ভালই রয়েছে। একশো দিনের কাজ থেকে আবাস প্রকল্পে দুর্নীতির ফলে সেই শক্তি আরও বাড়বে। আর নিয়োগ দুর্নীতি তদন্তের যে গতিপ্রকৃতি, তাতে শিক্ষিত, শহুরে মানুষের ভোট তৃণমূল পাবে না। সেই ভোটের বড় অংশ বিজেপির ঝুলিতে আসবে।’’ অন্য দিকে, রাজ্য বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘সংখ্যালঘু সমাজেরও তৃণমূলের উপর আর আগের মতো ভরসা নেই। একই সঙ্গে তাঁরা বুঝেছেন, লোকসভা নির্বাচনে জাতীয় দলের তকমা হারানো তৃণমূলকে সমর্থন দিয়ে কোনও লাভ নেই। সুতরাং, অমিত শাহজি যে লক্ষ্য দিয়েছেন তা পূর্ণ করা এমন কিছু কঠিন নয়।’’

বিজেপির এমন দাবি নিয়ে আগেই কটাক্ষ করেছে তৃণমূল। শাহ লক্ষ্য বেঁধে দেওয়ার পরেই দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছিলেন, ‘‘উনি ৩৫টি আসনের টার্গেট বেঁধে দিয়ে গিয়েছেন। আমি বলছি, শূন্য থেকে গোনা শুরু করবেন, ১-এ পৌঁছতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে। বিজেপি শূন্যে দাঁড়িয়ে থাকবে লোকসভায়! বিহার থেকে লোক ঢুকিয়ে ৩৫টি আসন পাওয়া যাবে না। বিধানসভা ভোটের আগে দেখেছিলাম, অমিত শাহ বলেছিলেন, অব কি বার, দুশো পার। কী ফল হয়েছে তা আমরা দেখেছি।’’ প্রদেশ কংগ্রস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘৩৫ অনেক দূর, বাংলায় তিনটে আসনও পাবে না বিজেপি!’’

তবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চান বিরোধীদের এ সব কটাক্ষে কান না দিয়ে যেখানে অতীতে ৪৫ শতাংশের কম ভোট মিলেছে, সেখানে লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরিকল্পনা করতে হবে। সে ভাবেই সাজাতে হবে লোকসভায় লড়াইয়ের প্রস্তুতি। ১৭ আসনে ৪৫ শতাংশ আছেই। আরও ১৮টিতে সেই জায়গায় পৌঁছতে হবে। আপাতত রাজ্য বিজেপির নতুন স্লোগান— ‘অব কি বার, ৩৫ পার।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement