BJP And Court

‘কোর্টে দেখা হবে’, পাড়ার হুমকিই এখন রাজনীতির ‘বাণী’ কেন? বিরোধীদের সঙ্গে ‘পরিবর্তন’ শাসকের

ভোট থেকে ভোটের প্রচার, চাকরির দাবি থেকে নিয়োগে দুর্নীতি— সব কিছু নিয়েই রাজ্যে বিরোধী বনাম সরকার, ভূরি ভূরি মামলা চলছে। তবে রাজনীতির ময়দানের তুলনায় আদালতেই বেশি ভরসা?

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৩ ১০:৩৩
Share:

মাঠ ছেড়ে কোর্টে কেন! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

মামলায় মামলায় জর্জরিত রাজ্য-রাজনীতি। কিছু হলেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সটান বলেন, ‘‘কোর্টে দেখা হবে!’’ তার জবাবে শাসক শিবিরও পাল্টা আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়। সাম্প্রতিক কালে রাজ্য সরকারও রাজভবনের পদক্ষেপের পাল্টা আদালতে যাওয়ার কথাই বলেছে। সম্প্রতি সেই মর্মে হুঁশিয়ারি শোনা গিয়েছে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর মুখে। গোছা গোছা মামলা লড়তেও হচ্ছে রাজ্য সরকারকে। পরিস্থিতি এমনই যে, প্রতিদিনের শিরোনামে বিচারপতি এবং বিচারকেরা।

Advertisement

সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতার দাবি, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি-সহ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অনেক মামলা ঝুলছে আদালতে। প্রাথমিক ভাবে মামলাগুলি কোনও রাজনৈতিক দলের না হলেও সেগুলি এখন পুরোপুরি ‘রাজনৈতিক’। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই বাদী ও বিবাদী পক্ষের আইনজীবীরা রাজনীতিতেও প্রতিষ্ঠিত। অনেকে বলছেন, অতীতে রাজ্যে কংগ্রেস বা বাম জমানার গোটা সময় মিলিয়ে বিরোধীপক্ষ মোট যা মামলা করেছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে বর্তমান জমানায়। দেখেশুনে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, রাজনীতির বেশি ভরসা কি তবে এখন আইন-আদালত?

এই প্রশ্নের উত্তরে বিরোধী শিবিরের বক্তব্য, রাজ্যে প্রশাসন ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকা না নেওয়াতেই আদালতের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। অন্য দিকে, শাসক শিবিরের বক্তব্য, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কম বলেই বিচারবিভাগের কাছে দরবার করছে বিরোধীরা। তবে মামলা করছে সরকার পক্ষও। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে লাগাতার সংঘাত চলছে বিকাশ ভবনের সঙ্গে রাজভবনের। তার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও বলেছেন, ‘‘উচ্চশিক্ষায় অযাচিত ভাবে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। রাজ্যপালের মাধ্যমে শিক্ষায় এই অভাবনীয় হস্তক্ষেপ হচ্ছে। আমরা শীর্ষ আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছি।’’

Advertisement

আদালতে যাওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি নজির তৈরি করেছএন অবশ্য বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। বিভিন্ন সময়ে তিনি পুলিসের মাঝারি মাপের অফিসারদেরও আদালতে নিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এমন উদাহরণ অনেক। বিজেপি নেতাদের বাড়ি ঘেরাও করার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটিকে ‘প্রতীকী’ বলে ঘোষণা করলেও আদালতে যায় বিজেপি। কলকাতা হাই কোর্টে জানিয়ে দেয়, তৃণমূল ওই কর্মসূচি করতে পারবে না। সেই রায়ের পর তৃণমূল নির্ধারিত দিনের পরদিন প্রতি ব্লকে সাধারণ বিক্ষোভ কর্মসূচি নেয়। যদিও কয়েক জায়গায় বিজেপি নেতাদের বাড়ি ঘেরাওয়ের অভিযোগ ওঠে। সেই বিষয়েও আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে শুভেন্দু হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ‘‘কোর্টে দেখা হবে’’ বলে।

বস্তুত, চলতি বছরেই বিভিন্ন দাবি ও অভিযোগ নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে এক ডজনেরও বেশি মামলা করা হয়েছে বিজেপির তরফে। মূল মামলাগুলির সঙ্গে জুড়ে যাওয়া অভিযোগের হিসাব কষলে সংখ্যাটা আরও বেশি।

রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল এত ‘আদালতমুখী’ কেন? শুভেন্দুর জবাব, ‘‘এ রাজ্যে গণতন্ত্র বলে যে কিছু নেই, তা প্রমাণিত। তাই আদালতে যেতে হয়।’’ বিরোধী দলনেতার সংযোজন, ‘‘এ রাজ্যে প্রধান বিরোধীদল কোনও কর্মসূচি করতে চাইলে তার অনুমতি দেয় না শাসকের দাস প্রশাসন। তাই আদালতের শরণাপন্ন হতেই হয়। আবার আদালতের নির্দেশও নানা ফিকিরে অমান্য করা হয়।’’

শুভেন্দুর সঙ্গে অনেকটা একমত সিপিএমের আইনজীবী-সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলায় তিনি আইনজীবী। বিকাশরঞ্জন বলেন, ‘‘বাংলায় বিরোধী পরিসরের রাজনীতির ক্ষেত্রটাই বদলে গিয়েছে। আগের মতো পরিস্থিতি নেই। তাই বাম জমানার সঙ্গে এখনকার তুলনা করা ঠিক হবে না।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘বিরোধীদের রাজনীতি আদালত-নির্ভর হয়ে গিয়েছে বলা ভুল হবে। কারণ, প্রশাসন যথাযথ ভাবে উদ্যোগী না হলে আদালতই একমাত্র আইনি ভরসাস্থল। সেটা না হলে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করা, লড়াই করাটা অশান্তির পরিবেশ তৈরি করে। সাংবিধানিক গণতন্ত্রে বিচারব্যবস্থার কাছে যাওয়ার যে সুযোগ রয়েছে, বিরোধীরা সেটাই ব্যবহার করছেন।’’

বাংলার মতো অন্য রাজ্যেও কি এ ভাবে আইনি পথেই ‘রাজনৈতিক মোকাবিলা’ হয়? বিকাশরঞ্জন বলেন, ‘‘দুর্নীতির সঙ্গে নেতা-মন্ত্রীরা যুক্ত হয়ে গেলে পুলিশ-প্রশাসন আর স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে আদালতই এক মাত্র শান্তিপূর্ণ পথ। সেটা না করলে রাজ্যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হত।’’

কংগ্রেসের আইনজীবী নেতা অরুণাভ ঘোষ আবার শুভেন্দু বা বিকাশরঞ্জনের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন। তাঁর কথায়, ‘‘বিরোধী দলগুলো দুমদাম আদালতে চলে যাচ্ছে আর কোর্টও রায় দিয়ে দিচ্ছে।’’ উদাহরণ দিয়ে অরুণাভ বলেন, ‘‘নির্বাচন নিয়ে পিটিশনে ২২৬ ধারা চলে না। দু-এক জন বিচারপতি রয়েছেন, যাঁরা ২২৬ ধারাকে মান্যতা দিচ্ছেন। বিষয়টা বেআইনি হয়ে যাচ্ছে।’’

নিজে বিরোধী দলের সদস্য হলেও রাজনীতির মাঠ ছেড়ে কোর্টে যাওয়ার প্রবণতার সমালোচনা করেছেন অরুণাভ। তিনি বলেন, ‘‘আদালতে মানুষ তখনই যায়, যখন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়। হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতিও তো বিরক্তি প্রকাশ করেছেন কথায় কথায় রাজনীতিকদের আদালতে হাজির হওয়া নিয়ে।’’ আত্মসমালোচনার সুরে প্রবীণ রাজনীতিক বলেন, ‘‘আমিও তো বিরোধী। কিন্তু আন্দোলন সংগঠিত করতে পারছি না। ফলে আদালতই ভরসা। কিন্তু এটা মেনে নিতে হবে যে, তৃণমূলের থেকে বিরোধীদের শক্তি কম বলেই তাদের এত আদালতে যেতে হচ্ছে।’’

অরুণাভের বক্তব্যের সঙ্গে শাসক তৃণমূলের ‘সুর’ ভিন্ন নয়। শাসক দলের বর্ষীয়ান বিধায়ক তথা মুখপাত্র তাপস রায়ের বক্তব্য, ‘‘মানুষের উপরে যাদের বিশ্বাস নেই, তারাই আদালতের উপর বেশি নির্ভর করে। কখনও কখনও আমাদেরও পাল্টা আদালতে যেতে হচ্ছে। কিন্তু বিরোধী রাজনীতির মঞ্চ হিসাবে তৃণমূল কখনও আদালতকে ব্যবহার করেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে পথে থেকেছেন, বাকিদেরও পথে থাকতে বলেছেন। সেটা করেই আমরা বিরোধী থেকে শাসক হয়েছি।’’

বাম আমলে তৃণমূলকে যে বেশি মামলা করতে হয়নি, তার কারণ দেখিয়েছেন বিকাশরঞ্জন। তাঁর যুক্তি, ‘‘কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণ ভাবে বাম আমলে পুলিশ-প্রশাসন তৎপরতার সঙ্গে নিরপেক্ষ ভূমিকা নিত। ফলে বিরোধীদের এত আদালতে যেতে হত না।’’ বিকাশরঞ্জনের কথায়, ‘‘বাম আমলে সিঙ্গুরে বিক্ষোভ দেখাতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন একটা সভা করতে গেলেই অনুমতি মেলে না!প্রশাসন এতটা দলনির্ভর হয়ে যাওয়াতেই বিরোধীদের আদালতের উপরে নির্ভরতা বাড়াতে হচ্ছে।’’

প্রকাশ্যে না বলতে চাইলেও ইদানীং বিজেপির আদালতে যাওয়ার পরিমাণ যে বেড়েছে, তা একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন দলের রাজ্য নেতাদের একাংশও। এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘আগেও মামলা করতে হয়েছে। কিন্তু ইদানীং সেটা বেড়েছে। দলের সাংসদ ২ থেকে ১৮ হতে বা বিধায়ক সংখ্যা ৩ থেকে ৭৭ করতে যত মামলা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে এখন।’’ দলের কর্মীদের মধ্যেও আন্দোলনে নামার চেয়ে আদালতের মুখাপেক্ষী হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে বলেই নেতাদের অভিমত। এক নেতার কথায়, ‘‘চাকরি-দুর্নীতি থেকে বিভিন্ন কেলেঙ্কারি নিয়ে আদালত কী রায় দেবে, সিবিআই বা ইডি কী করবে, তা নিয়েই যত আলোচনা। কিন্তু এই বিষয়গুলো নিয়ে যে সাধারণ ভোটারের কাছে যেতে হবে, সেই মনোভাবটা কমে গিয়েছে কর্মীদের মধ্যে।’’

আদালত-নির্ভরতা নিয়ে দলের ভিতরের ‘দোলাচল’ অবশ্য মানতে নারাজ রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘বিজেপি কোর্টেও আছে, মাঠেও আছে। তবে অসহিষ্ণু, অসংবেদনশীল সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলন করলে কোনও প্রভাব পড়ে না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই আদালতে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement