(বাঁ দিকে) শুভেন্দু অধিকারী এবং সুকান্ত মজুমদার (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
তাঁরা প্রার্থী ঘোষণা করেছেন সকলের আগে। ফলে বিজেপি নেতারা দাবি করতেই পারেন, আসন্ন উপনির্বাচনে ভাল ফলের উপর তাঁরা গুরুত্ব দিচ্ছেন। বস্তুত, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সম্প্রতি বলেছেন, মানুষ ভোট দিতে পারলে তাঁরা উত্তরের মাদারিহাট তো বটেই, দক্ষিণের মেদিনীপুর আসনটিও জিততে পারেন। কিন্তু একান্তে রাজ্য বিজেপির অধিকাংশ নেতাই মানছেন, রাজ্যের ছ’টি আসনে উপনির্বাচনে লড়তে উৎসাহের একটা ‘খামতি’ রয়েছে।
সাধারণ নির্বাচন এবং উপনির্বাচনের ফারাক আছে। উপনির্বাচনে শূন্যস্থান পূরণ হয়, সরকার বদলায় না। ফলে ভোটারদের ‘বুথমুখী’ হওয়ার প্রবণতা কম থাকে। সেই সঙ্গে শাসকের পক্ষেই ভোট যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ, ভোটারেরাও চান সরকারের সঙ্গে থাকাটা নিশ্চিত করতে। শাসকের বিরুদ্ধে পেশিশক্তি ব্যবহারের সঙ্গে নানা কৌশলের অভিযোগও ওঠে। তার মধ্যে সত্যতা যে থাকে না, তা-ও নয়। বিজেপি মনে করছে, এই উপনির্বাচনেও তার পুনরাবৃত্তিই হবে।
আগামী ১৩ নভেম্বর ছ’টি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন। ওই আসনগুলিতে যে উপনির্বাচন হবে, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল গত ৪ জুন লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরেই। কারণ, লোকসভা ভোটে বিজেপির এক জন এবং তৃণমূলের পাঁচ বিধায়ক সাংসদ হন। রাজ্য বিজেপির অনেকেই মনে করেন, সেই সময় থেকেই উপনির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু প্রার্থী ঘোষণার আগে পর্যন্ত বোঝা যায়নি, বিজেপি তাদের জেতা আসন মাদারিহাট ধরে রাখতে কার উপরে নির্ভর করছে। নাম ঘোষণার পরে প্রার্থী রাহুল লোহার প্রচার শুরু করেছেন বটে। কিন্তু আগে থেকে তাঁর প্রস্তুতি ছিল না। থাকলে মাদারিহাটের ‘মজবুত’ সংগঠনকে উপনির্বাচনের জন্য আরও মজবুত করা যেত।
প্রসঙ্গত, উপনির্বাচনে বিজেপির পক্ষে একমাত্র ‘ইতিবাচক’ আসন মাদারিহাট। ২০১৬ এবং ২০২১ সালে ভাল ব্যবধানে জিতেছিলেন মনোজ টিগ্গা। বিধানসভায় বিজেপির মুখ্য সচেতক মনোজ এখন আলিপুরদুয়ারের সাংসদ। গত লোকসভা নির্বাচনে তো বটেই, ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটেও মাদারিহাট বিধানসভা বিজেপিকে এক নম্বরে রেখেছিল। তবে বিজেপি কখনও এই আসনে উপনির্বাচনে লড়েনি। তবু মাদারিহাটে জয় নিয়ে নিশ্চিন্ত সাংসদ মনোজ। ভোট ঘোষণার পর থেকেই সেখানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা মনোজের কথায়, ‘‘এখানে আমাদের খুব বেশি প্রস্তুতি দরকার হয় না। এই মাটি বিজেপির। প্রার্থী কে হলেন, সেটাও বড় বিষয় নয়। সবাই মিলে ঝাঁপিয়েছি। জয় নিশ্চিত।’’
মনোজ নিশ্চিত হলেও রাজ্যনেতৃত্বের একাংশের আশঙ্কা, ভোটের ফল ৬-০ হতে পারে। এক নেতার কথায়, ‘‘শুধু মাদারিহাট নয়, মেদিনীপুর, নৈহাটি এবং তালড্যাংরাতেও আমরা লড়াইয়ের জায়গায় আছি। কিন্তু তৃণমূল ভোট হতে দেবে কি!’’
বলছেন বটে। কিন্তু সময় থাকতে ওই চার আসনে বিজেপি সে ভাবে সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিয়েছে? প্রার্থী চিহ্নিত করা বা বুথে বুথে যাঁরা এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে? এ সব প্রশ্নে বিজেপি নেতারা হয় নীরব থাকছেন। নয়তো অতীত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে উপনির্বাচনে শাসকদলের ‘একপেশে’ ভোট করানোর উদাহরণ দিচ্ছেন।
গত বিধানসভা ভোটে মেদিনীপুরে বিজেপি হারলেও ওই আসনে বিজেপির ‘নিজস্ব ভোট’ রয়েছে। আরজি কর-কাণ্ডের জেরে শহুরে ভোটারদের মধ্যে একটা ‘শাসকবিরোধী হাওয়া’ তৈরি হয়েছে। মেদিনীপুরে শহরে ভোটারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সেখানে প্রার্থী করা হয়েছে দলের দীর্ঘ দিনের কর্মী শুভজিৎ রায়কে। কিন্তু প্রার্থী ঘোষণার সন্ধ্যাতেও শুভজিৎ বা জেলার নেতারা জানতেন না কে প্রার্থী। ফলে প্রস্তুতি ছাড়াই ভোটের ময়দানে নেমেছে বিজেপি। যদিও লড়াই নিয়ে আশাবাদী মেদিনীপুরের প্রার্থী। শুভজিৎ বলেন, ‘‘এখানে আমাদের অনেক সমর্থক। সম্প্রতি তা বেড়েছে। ফলে শাসক শক্তি প্রয়োগ করলেও আমরা লড়াইয়ে আছি।’’
গত বিধানসভা নির্বাচনের পরে দিনহাটা, রানাঘাট দিয়ে শুরু করে সম্প্রতি রায়গঞ্জ, বাগদা, রানাঘাট দক্ষিণের মতো জেতা আসন উপনির্বাচনে খুইয়েছে বিজেপি। ২০২১ সালের পর একটি উপনির্বাচনেও জয় পায়নি পদ্মশিবির। প্রতি বারেই নেতারা শাসকের বিরুদ্ধে ভোটে ‘বলপ্রয়োগ’ করার অভিযোগ করেছেন। কিন্তু দলের সমর্থক ভোটারদের কেন বুথ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায়নি, তার সদুত্তর মেলেনি। বিজেপি সূত্রে এ-ও জানা গিয়েছে যে, পর্যালোচনা বৈঠকে হারের কারণ নিয়ে সে ভাবে কাটাছেঁড়াও হয়নি।
শাসক তৃণমূল এই জায়গাটাতেই সাংগঠনিক ভাবে বিজেপির চেয়ে ‘এগিয়ে’। উপনির্বাচন মানেই শাসক জিতবে, এই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে বাম জমানায় ২০০৯ সালে জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর পশ্চিম আসন জিতেছিল তৃণমূল। সিপিএমের দাপুটে মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর মৃত্যুর পরে উপনির্বাচনে পূর্ব বেলগাছিয়াও জিতেছিল তৃণমূল। পরিকল্পনায় খামতি ছিল না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সুভাষ-জায়া রমলা চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে সুভাষের ‘স্নেহধন্য’ সুজিত বসুকে প্রার্থী করে বাজিমাত করেছিলেন মমতা। তবে তৃণমূল জমানাতেও এমন অন্তত দু’টি নজির রয়েছে। ২০১৯ সালে বিজেপিতে যোগ দিয়ে সাংসদ হওয়া অর্জুন সিংহের ছেড়ে যাওয়া আসন ভাটপাড়ায় তাঁর পুত্র পবন সিংহ বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন। মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীকে পরাস্ত করেন সিপিএম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস। সাগরদিঘির সেই ফল রাজ্য রাজনীতিতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। তৃণমূল পর্যালোচনায় বসে খোঁজ করতে শুরু করে, দলের কেউ ওই পরাজয়ের পিছনে রয়েছেন কি না। রাজ্যের অন্যত্র এমন ‘সম্ভাবনা’ রয়েছে কি না, সেই সমীক্ষাও করে শাসকদল। শেষে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মাস তিনেকের মধ্যে বাইরনকে তৃণমূলে নিয়ে নেন। তাতে কিছু ‘নিন্দা’ হয়েছিল বটে। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ জেলায় তিনটি আসনেই জয় পায় তৃণমূল। এই প্রথম।
আসন্ন উপনির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে মূল লড়াই হবে তৃণমূলেরই। সিপিএম-কংগ্রেসকে খুব একটা ‘প্রাসঙ্গিক’ বলে মনে করছেন না কেউই। রাজ্যে আরজি কর-কাণ্ডের পরে এই প্রথম কোনও ভোট হতে চলেছে। তৃণমূল যেমন এই ভোটে অন্তত তিনটি কেন্দ্রে ‘শহুরে ভোট’ মাপবে, তেমনই বিজেপির কাছে এই ভোট লোকসভা ভোটের কাছে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই হতে পারত। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিজেপি প্রার্থিতালিকা ঘোষণার পরে এখনও পর্যন্ত উপনির্বাচন নিয়ে রাজ্য স্তরের কোনও বৈঠকও করে উঠতে পারেনি। সভাপতি সুকান্ত মজুমদার-সহ রাজ্য নেতারা আপাতত দলের সদস্য সংগ্রহ অভিযান নিয়ে ব্যস্ত। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী নিজের মতো করে নানা বিষয়ে মিছিল-মিটিং করে চলেছেন। বাকিরা বলছেন, ‘‘মাদারিহাট ধরে রাখতে পারলেই যথেষ্ট।’’