Coronavirus

‘কে বলল ক্ষতি?’ গোমূত্র পানের পক্ষে জোর সওয়াল দিলীপ ঘোষের!

গোমূত্র পানে কোনও ক্ষতি হয় না বলেও এ দিন দাবি করেছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২০ ২৩:১১
Share:

গোমূত্র পান করাচ্ছেন বিজেপি নেতা নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়।

গোমূত্র পান করানোর কর্মসূচির সঙ্গে দলের দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল সোমবার। কিন্তু মঙ্গলবার বদলে গেল বয়ান। গোমূত্র পান করা বা করানোয় আপত্তির কিছুই নেই বলে মন্তব্য করলেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ। ‘‘এই প্রথম কি কেউ গোমূত্র খাচ্ছেন? বাড়িতে নারায়ণের সিন্নি দেওয়ার সময়ে যে পঞ্চগব্য ব্যবহৃত হয়, তাতে গোমূত্র থাকে না?’’ প্রশ্ন দিলীপ ঘোষের। আর রাজ্য সভাপতির এই অবস্থান জানার পরেই সুর বদল অন্য নেতাদেরও। ‘‘গোমূত্র পানে অপকারই হয়, এমনটাও তো আমরা জানি না। গবেষণা হোক।’’ বললেন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু।

Advertisement

সংসদের অধিবেশন চলায় দিলীপ ঘোষ এখন দিল্লিতে। তিনি রাজ্যে না থাকাকালীনই সোমবার জোড়াসাঁকো এলাকার বিজেপি নেতা নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় গোমাতার পুজো এবং স্থানীয় লোকজনকে গোমূত্র পান করানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন। করোনা রুখতে এই উদ্যোগ বলে জানিয়েছিলেন নারায়ণ। করোনার কোনও প্রতিষেধক যখন বেরোয়নি, তখন একমাত্র গোমূত্রই করোনা রুখতে পারে বলে তিনি জোর গলায় দাবি করছিলেন।

বুকে বিজেপির প্রতীক সাঁটিয়ে এবং গেরুয়া পোশাক পরে ওই বিজেপি নেতা গোমূত্র পান করালেও বিজেপি নেতারা সোমবার জানিয়েছিলেন, ওটা নারায়ণের ব্যক্তিগত উদ্যোগ, দলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল রাজ্য বিজেপির অনেকেই ওই কাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের দূরত্ব তৈরি করতে চাইছেন। দিলীপ ঘোষ নিজে যে হেতু কলকাতাতেই ছিলেন না, তাই গোমূত্র কাণ্ডের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করা তাঁর পক্ষে আরও সহজ ছিল। কিন্তু দিলীপ সে পথে হাঁটেননি। গোমূত্র পান করা বা করানোয় আপত্তির কিছুই দেখছেন না বলে মঙ্গলবার তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: গোমূত্র বেচতে নেমে ডানকুনিতে গ্রেফতার এক

দিল্লি থেকে এ দিন দিলীপ ঘোষ ফোনে আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘হিন্দুর বাড়িতে যখন সত্যনারায়ণের সিন্নি দেওয়া হয়, তখন পঞ্চগব্য লাগে। তার মধ্যে গোমূত্রও থাকে। হিন্দুদের আরও নানা আচার-অনুষ্ঠানে গোমূত্র ব্যবহার করা হয়। আজ নয়, হাজার হাজার বছর ধরে এটা হয়ে আসছে। জেনে হোক বা না জেনে, গোমূত্র অনেকেই খেয়েছেন। এখন হঠাৎ এত হইচই কেন, জানি না।’’

গোমূত্র পানে কোনও ক্ষতি হয় না বলেও এ দিন দাবি করেছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এটা কে বলল যে, গোমূত্র খেলে ক্ষতি হয়? হাজার হাজার বছরের পরম্পরা। কার ক্ষতি হয়েছে? গোমূত্র খেয়ে কে অসুস্থ হয়েছেন? ক’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে?’’ দিলীপের ব্যাখ্যা, ‘‘রোজ কত মানুষ গোমূত্র কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। এমনি এমনি তো হচ্ছে না।’’ গোমূত্রের উপকারিতা রয়েছে এবং প্রাচীন ভারতের গবেষকরাই সে উপকারিতার কথা জেনেছিলেন, তাই হাজার হাজার বছর ধরে গোমূত্রকে পবিত্র হিসেবে হিন্দুরা মেনে আসছেন বলে দিলীপ ঘোষের মত।

আরও পড়ুন: সরকারি প্রতিষ্ঠানে করোনা-টেস্টের চাপ বাড়়ছে, দরজা খুলতে পারে বেসরকারি ল্যাবের

যাঁরা গোমূত্র পানের সমালোচনা করছেন, তাঁরা কি কখনও গোমূত্রের গুণাগুণ নিয়ে গবেষণা করেছেন? গোমূত্র করোনার মতো রোগের প্রকোপ রুখতে পারে কি না, তা কি এখনকার কোনও বিজ্ঞানী পরীক্ষা করে দেখেছেন? প্রশ্ন মেদিনীপুরের সাংসদের। পরীক্ষা না করেই গোমূত্রের বিরুদ্ধে জিগির তোলা হচ্ছে— উষ্মার সঙ্গে এ কথা বলছেন দিলীপ ঘোষ।

কিন্তু চিকিৎসকরা তো বলছেন, করোনা সংক্রমণ রোখার জন্য গোমূত্র খাওয়া বা খাওয়ানো সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। গোমূত্র খেলে অসুস্থ হয়ে পড়ার বা অন্য কোনও সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকছে বলে তো তাঁরা জানাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে চিকিৎসকদের এ দিন একহাত নিয়েছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি। তিনি বলেছেন, ‘‘চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে পয়সা খেয়ে ওষুধ চালিয়ে দেন। তিনি যে ওষুধ লিখছেন, সেটাই সবচেয়ে ভাল বলে দাবি করেন। তাঁরা বললেই মেনে নিতে হবে গোমূত্র অপকারী, এর কোনও মানে নেই।’’

কিন্তু নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় নামে যে বিজেপি নেতা গোমূত্র পান করানোর আয়োজন করেছিলেন, তিনি কি দলের অনুমোদন নিয়েছিলেন? রাজ্য বিজেপির সভাপতি বলছেন, ‘‘অনুমোদন নেওয়ার কী আছে? তিনি মনে করেছেন, গোমূত্রে উপকার হতে পারে। তিনি খেয়েছেন। যাঁদের খাইয়েছেন, তাঁদেরও তো জোর করে খাওয়াননি। এতে আপত্তি করার কিছু থাকতে পারে না।’’ যাঁরা জোড়াসাঁকোর ওই বিজেপি নেতার সমালোচনায় মুখর, তাঁদেরই আক্রমণ করেছেন দিলীপ। তিনি বলেছেন, ‘‘যাঁরা বলছেন, গোমূত্রে করোনা সারে না, তাঁরাই বলুন কিসে সারে। তাঁরা কিছু আবিষ্কার করতে পেরেছেন? যদি করে থাকেন, তা হলে সেটা নিয়ে মানুষের কাছে যান। নিজেরা তো মানুষের কাছে যাবেন না। যাঁরা এই বিপদের মুহূর্তে মানুষের কথা ভাববেন, ঘরে বসে বসে এঁরা শুধু তাঁদের সমালোচনা করবেন।’’

রাজ্য সভাপতির এই বয়ান শুনেই সুর বদলেছেন রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুও। সোমবার তিনি বলেছিলেন, ‘‘জোড়াসাঁকোর ওই বিজেপি নেতা যা করেছেন, তার সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই।’’ মঙ্গলবার সায়ন্তন বললেন, ‘‘কেউ যদি কিছু খাওয়ান এবং ঘোষণা করেই খাওয়ান যে, কী খাওয়াচ্ছেন, তাতে কারও আপত্তির কী আছে? যাঁরা খাচ্ছেন, তাঁরা তো জেনেশুনেই খাচ্ছেন।’’ কিন্তু গোমূত্রে সংক্রামক রোগ রোখা যায়, এটা কি তিনি বিশ্বাস করেন? সায়ন্তন বলেন, ‘‘গোমূত্র খেলে কী হয়, সেটা আমরা জানি না। উপকার হয়, নাকি অপকার হয়, জানি না। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখুন না। বিষয়টা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।’’

জোড়াসাঁকোর ঘটনা সামনে আসতেই রাজ্য জুড়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছিল সোমবার। বিজেপি প্রথমে ওই কাণ্ডের সঙ্গে দলের দূরত্ব তৈরি করতে চেয়েছিল, সে কথা ঠিক। কিন্তু এক জন বিজেপি নেতা বুকে দলের প্রতীক সেঁটে যে ভাবে গোমূত্র পান করাচ্ছিলেন লোকজনকে, তাতে কটাক্ষের আঁচ বিজেপি পুরোপুরি এড়াতে পারছিল না। দিলীপ ঘোষ নিজেও গরুর দুধের গুণাগুণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে কিছু দিন আগে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারতীয় গরুর দুধে সোনার ভাগ রয়েছে। গরুর পিঠে যে কুঁজ থাকে, তার মধ্যে ‘স্বর্ণনাড়ি’ থাকে এবং তাতে সূর্যালোক পড়লে সোনা উৎপন্ন হয়— পূর্ব বর্ধমানে একটি ভাষণে এমনই বলেছিলেন দিলীপ। তা নিয়ে শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা দেশে হইচই শুরু হয়ে যায়। একটি রাজ্যে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতা যিনি, তিনি কী ভাবে এমন মন্তব্য করতে পারেন? এই প্রশ্ন তুলে বিস্ময় প্রকাশ করতে শুরু করেছিল বিভিন্ন মহল। রাজনৈতিক পরিসরে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় দিলীপ ঘোষের উদ্দেশে কটাক্ষের বান ডাকতে শুরু করেছিল।

দিলীপ কিন্তু সেই কটাক্ষের মুখেও নিজের মন্তব্য প্রত্যাহার করার রাস্তায় হাঁটেননি। তাঁর মন্তব্যের অপব্যাখ্যা হচ্ছে বা তিনি অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছিলেন— এমন কিছুও দিলীপ ঘোষ বলেননি। এ বার গোমূত্র কাণ্ডেও তিনি যে অবস্থান নিলেন, তা বেশ চমকে দেওয়ার মতো। গোবলয়ের বাসিন্দাদের অনেকের মধ্যে গরু সম্পর্কে যে রকম ধারণা রয়েছে, বাংলায় কিন্তু তেমন ধারণা পুরোপুরি নেই। সুতরাং গো-সেবা বা গোমূত্র পানের মতো বিষয়কে বাংলার রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিসরে অনেকেই কটাক্ষের বিষয় বলে মনে করেন। সে কথা জেনেও দিলীপ ঘোষ কী ভাবে সমর্থন করলেন গোমূত্র পান করানোর উদ্যোগকে, তা নিয়ে বিস্ময় কাটছে না রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement