‘মিডলম্যান’ প্রসন্ন রায়। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
তিনি এসএসসি মামলায় অভিযুক্ত। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ। আবার তাঁর বাড়িতেই দিলীপ ঘোষের বাড়ির দলিলের ফোটোকপিও পাওয়া গিয়েছে। তিনি প্রসন্ন রায়। নিয়োগ মামলায় গ্রেফতার হলেও এখন জামিনে মুক্ত। তাঁকে জামিন দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু তিনি আসলে কে?
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এই প্রসন্নের একাধিক বাড়ি, অফিসে তল্লাশি শুরু করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। নিউ টাউনের এক অভিজাত আবাসনে ফ্ল্যাট রয়েছে প্রসন্নের। সেই ফ্ল্যাট ছাড়াও প্রসন্নের নামে থাকা আরও একটি আবাসনে তল্লাশি চালাচ্ছে ইডি। সেটি প্রসন্নের অফিস। ইডি এবং সিবিআই সূত্রে খবর, নামে-বেনামে কম করে ৮০টির উপর সংস্থা রয়েছে প্রসন্নের। এ ছাড়া তাঁর নিজের নামে এবং স্ত্রীর নামে রয়েছে বিপুল সম্পত্তি। তার কিছু রয়েছে বিধাননগর, নিউ টাউনে বাকি শহরের অন্যান্য জায়গায়।
অথচ এই প্রসন্ন প্রথম জীবনে থাকতেন নারকেলডাঙার একটি ছোট্ট ভাড়াবাড়িতে। বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। সংসার চালানোর জন্য একটি টিউশন সেন্টার খুলেছিলেন। সেই অতি সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত সংসার থেকেই রকেটগতিতে উত্থান প্রসন্নের। কিন্তু কার প্রসন্নতায়?
এসএসসি নিয়োগ মামলায় প্রসন্নের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি উপদেষ্টা কমিটির প্রাক্তন প্রধান শান্তিপ্রসাদ সিংহের ‘ঘনিষ্ঠ’। এক জন ‘মিডলম্যান’। আবার রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল বলে জানা গিয়েছিল সিবিআই সূত্রে। পরে তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়ে বিজেপি নেতা তথা সাংসদ দিলীপ ঘোষের বাড়ির দলিলের ফোটোকপিও পেয়েছিলেন গোয়েন্দারা। যা নিয়ে পরে খোদ দিলীপকে ব্যাখ্যাও দিতে হয়। দিলীপ বলেছিলেন, তিনি যে আবাসনে থাকতেন, প্রসন্ন ছিলেন সেই আবাসনের সেক্রেটারি। সেই জন্যই তাঁর বাড়ির দলিল ছিল প্রসন্নের কাছে। তবে প্রসন্ন যে শুধুমাত্র এক জন ‘মিডলম্যান’ নন তখনই বোঝা গিয়েছিল।
সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, বিভিন্ন ভুয়ো সংস্থা খুলে নিয়াগ দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করার কাজ করতেন প্রসন্ন। এর জন্য নিজের কর্মচারীদের নামেও সংস্থা খুলে ফেলেছিলেন। ছিল গাড়ি, বাড়ি, হোটেল, নির্মাণ ব্যবসা সংক্রান্ত সংস্থাও। এ ছাড়া টাইলস বিক্রির দোকান। এমনকি, চায়ের দোকানও।
সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, এই সমস্ত ব্যবসায় নিযুক্ত কর্মচারীদের প্রসন্ন কাজে লাগাতেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য। শুধু তা-ই নয়, এই কর্মচারীদের মাধ্যমেই প্রসন্ন টাকার লেনদেনও করাতেন বলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের অনুমান। সিবিআইয়ের দাবি রোহিত ঝা নামের এক কর্মচারীর মাধ্যমে প্রসন্ন এজেন্টদের থেকে টাকার বিনিময়ে চাকরিপ্রার্থীদের নাম সংগ্রহ করেছিলেন। তার পর সেই নাম সরাসরি অথবা সমরজিৎ আচার্য নামে এক ব্যক্তির মারফত পৌঁছে দিয়েছিলেন শান্তিপ্রসাদের কাছে। এই প্রক্রিয়াতেই কোটি কোটি টাকা এসেছে প্রসন্নের কাছে। তদন্তকারীদের ধারণা, বেআইনি সেই টাকা নিজের ভুয়ো সংস্থার মাধ্যমে বৈধ করেছেন প্রসন্ন।
সিবিআই অন্তত ২০০-র উপর ফরেন্সিক অডিট করেছে প্রসন্নের সংস্থার। তাতে দেখা গিয়েছে, প্রসন্নের বিভিন্ন ব্যবসায় যে সমস্ত খরচ দেখানো হয়েছে তা স্বাভাবিক নয়। হয়তো দেখা গিয়েছে একটিই গাড়ি একই ব্যক্তি নিয়ম করে প্রতি দিন ২০০০ কিলোমিটার করে চালিয়েছেন। তার পেট্রোল খরচ বাবদ দেখানো হয়েছে মোটা টাকার খরচ। আবার কোনও ব্যক্তি হয়তো প্রসন্নের থেকে রোজ কেজি কেজি চায়ের পাতা কিনেই গিয়েছেন মাসের পর মাস। এই সমস্ত অদ্ভুত লেনদেনের আড়ালেই দুর্নীতির কালো টাকা প্রসন্নের ভুয়ো সংস্থা ঘুরে সাদা হয়েছে। পৌঁছেছে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। কার জন্য এত কিছু করেছেন প্রসন্ন, কার বদান্যতায় দীর্ঘ দিন ধরে তিনি আইন থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছেন, আপাতত সেই সূত্রই খুঁজছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা।
উল্লেখ্য, নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত দু’টি মামলার তদন্তে নেমে প্রসন্নের নাম পেয়েছিল সিবিআই। গ্রুপ ডি নিয়োগ মামলা এবং নবম-দশমের শিক্ষক নিয়োগ মামলা। প্রসন্নকে এর পরে গ্রেফতারও করেছিল সিবিআই। তবে গ্রেফতার করা হলেও প্রসন্নের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়নি। চার্জশিট দেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলেও তার প্রেক্ষিতে কোনও পদক্ষেপ না করায় বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন প্রসন্ন। বেশ কিছু শর্ত দিয়ে সিবিআইয়ের মামলায় তাঁকে জামিন দেয় শীর্ষ আদালত।