পাশে: নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন এবং অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলি করম্উল্লা। ফাইল চিত্র
উত্তর ২৪ পরগনার সভা মঞ্চে উঠছেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। কার্বাইন হাতে সামনে নিরাপত্তারক্ষী। আচমকাই ম্যাগাজ়িন খুলে পড়ল মুখ্যমন্ত্রীর জুতোর উপরে। ছিটকে গেল পাঁচটি গুলি। ভয়ে কাঁপতে শুরু করলেন কম্যান্ডো বাহিনীর সেই নিরাপত্তারক্ষী। মুখ্যমন্ত্রী শুধু তাঁকে বললেন, ‘গুলি কুড়িয়ে নিন’!
ওই ঘটনার প্রসঙ্গ তুলতেই বিস্ময় প্রকাশ করলেন সেই নিরাপত্তারক্ষী মহম্মদ আলি করম্উল্লা। বললেন, ‘‘উঁচু মঞ্চে ওঠার সময়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটের সঙ্গে কার্বাইনের ধাক্কায় ম্যাগাজ়িন খুলে গিয়েছিল। পরে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর আপ্ত সহায়ককে ডেকে বলে দিয়েছিলেন, মঞ্চের নীচে থাকা পুলিশ আধিকারিকদের যেন জানিয়ে দেওয়া হয় আমার কোনও দোষ নেই।’’
কথাটা বলে কিছু ক্ষণ থামলেন শ্রীরামপুরের বাসিন্দা আলি করম্উল্লা। যাঁর ২৯ বছরের চাকরি জীবনে রয়েছে এমন অনেক স্মৃতি। এখনও বাংলার দুই নোবেলজয়ী কলকাতায় পা দিলেই নিরাপত্তার জন্য ডাক পড়ে ঊনষাট বছরের পুলিশকর্মী আলির। কর্মক্ষেত্রে এ নামেই পরিচিত তিনি।
জ্যোতিবাবুর মতো মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যেরও নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন এই পুলিশকর্মী। যে দিন বুদ্ধবাবু নিরাপত্তা ছাড়লেন, সে দিনের কথা উঠতেই খানিক চুপ থেকে আলি করম্উল্লা বললেন, ‘‘আলিমুদ্দিন থেকে বাড়ি ফিরে সকলকে বললেন, ‘আগামিকাল থেকে আমার আর এত নিরাপত্তা লাগবে না। পুলিশ কমিশনারকে বলে দিয়েছি। আপনারা ভাল থাকবেন।’’
দুই মুখ্যমন্ত্রী, নোবেলজয়ী ছাড়াও কলকাতায় আসা স্টিভ ওয়, আশা ভোঁসলে, লোকসভা ভোটের পুলিশ পর্যবেক্ষক বিবেক দুবে-সহ আরও অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির নিরাপত্তার দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। ’৯১ সালে কলকাতা পুলিশের ষষ্ঠ ব্যাটেলিয়নে কনস্টেবল পদে যোগ দেওয়ার দু’বছর পরে বিশেষ কম্যান্ডো প্রশিক্ষণ নেন। ’৯৭ সাল পর্যন্ত জ্যোতিবাবুর নিরাপত্তায় ছিলেন কলকাতা পুলিশের প্রথম কম্যান্ডো ব্যাচের সদস্য আলি করম্উল্লা। ’৯৮ সালে স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চে যোগ দিয়েও কিন্তু থেকে যান মুখ্যমন্ত্রীর ডিউটিতে।
সে বছর নোবেল জয় করে অর্মত্য সেন কলকাতায় আসার পরে তাঁর ‘পিএসও’ (পার্সোনাল সিকিউরিটি অফিসার) করে পাঠানো হয়েছিল আলি করম্উল্লাকে। তখন থেকেই দু’জনের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সূত্রের খবর, বুদ্ধবাবুর আমলে এক বার অর্মত্য সেন কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে জানতে পারেন, আলিকে পিএসও হিসেবে পাঠানো হয়নি। তখন তিনিই ফোন করে ‘আলিভাই’কে চেয়ে নিয়েছিলেন। আলি করম্উল্লার কথায়, ‘‘স্যর অন্য মানুষ। হয়তো ওঁর গাড়ির সামনে কোনও রিকশা যাচ্ছে, আমরা সেটা সরতে বললে উনি বিরক্ত হন। বলেন, ‘সরাচ্ছেন কেন? পিছনেই যাব। তেমন হলে একটু হেঁটেই এগিয়ে যাই।’ যদিও আমরা নিরাপত্তার জন্য নামতে দিই না।’’
‘‘অধ্যাপক সেনের মতোই একই ব্যক্তিত্ব তাঁর ছাত্র অভিজিৎবাবুরও’’— কথাটা শেষ করেই আলি করম্উল্লা বললেন, ‘‘কোনও কথার উত্তর দেওয়ার আগে ‘আজ্ঞে’ শব্দটা ব্যবহার করেন অভিজিৎবাবু। মানুষকে এই সম্মান দেওয়ার চল তো এখন প্রায় হারিয়েই গিয়েছে। তাই প্রথম দিন ওঁর মুখে শব্দটা শুনে চমকে গিয়েছিলাম।’’ অল্প দিনেই ওই নিরাপত্তারক্ষী তাঁদের এতই কাছের হয়ে গিয়েছেন যে অভিজিৎবাবুর মতোই তাঁর মা নির্মলাদেবীও ভালবেসে তাঁকে ‘আলিভাই’ বলে ডাকেন।
আলি করম্উল্লার পরিবারের সঙ্গেও পরিচয় রয়েছে অর্মত্য সেনের। তাঁর পরামর্শ মতোই মেয়েকে দর্শন নিয়ে পড়াচ্ছেন ওই পুলিশকর্মী। টাকার অভাবে যাতে অন্যের পড়া বন্ধ না হয়ে যায়, সে দিকেও নজর রাখেন তিনি। তাই সংবাদপত্র দেখে পৌঁছে গিয়েছিলেন হুগলিতে। সব দেখেশুনে এক খেতমজুরের ছেলে দেবাশিস মল্লিকের উচ্চশিক্ষার ভার তুলে নেন নিজের কাঁধে। প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ঋণ নিয়ে আজও চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর পড়াশোনার খরচ।
গাড়িতে যাতায়াতের পথে বিষয়টি শুনে প্রশংসা করেছেন খোদ অর্মত্য সেন। এমনকি তিনি দেবাশিসকে শান্তিনিকেতনে ডেকে কথাও বলেছেন।
এত ভিআইপির নিরাপত্তা সামলানো, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বীকৃতি কি কিছু মিলেছে? স্মিত হেসে আলি করম্উল্লা বললেন, ‘‘প্রফেসর সেনের কথাই সব সময় মেনে চলি। কাজ করে যাও। স্বীকৃতির আশা করো না।’’