বাইরনের কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগদানের পর সামগ্রিক জোটের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। —নিজস্ব চিত্র।
মাস তিনেক আগে তাঁর দলবদলের সম্ভাবনায় জল ঢেলে কংগ্রেসের টিকিটে জয়ী হওয়া মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির বিধায়ক বলেছিলেন, ‘‘আমাকে তৃণমূল কিনতে পারবে না। দরকারে আমি তৃণমূলকে কিনে নেব।’’ কিন্তু দিন যত গিয়েছে বাইরন বিশ্বাসের বয়ানে বদল ঘটেছে। কখনও তিনি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে চান। কখনও বলেছেন ‘এখনও’ কংগ্রেসে আছেন। অবশেষে সোমবার পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে তৃণমূলের পতাকা তুলে নিয়ে হাত ছাড়ার কথা ঘোষণা করলেন। জানালেন, কংগ্রেসে থেকে কাজ করতে পারছিলেন না। তাই শাসকদলে যোগদান। সাগরদিঘির মানুষের কথা ভেবেই এই দলবদলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আবার এ-ও বলেছেন, তিনি আসলে তৃণমূলেই ছিলেন। কংগ্রেসের ভোটে জেতেনইনি। প্রয়োজনে সেই পরীক্ষা (ভোটে) দিতে তিনি প্রস্তুত।
বাইরনের দলবদলের আকস্মিকতায় কংগ্রেস বলছে, হুমকি-ফোনে শাসকদলে ভিড়তে বাধ্য হয়েছেন সাগরদিঘির বিধায়ককে। একই সঙ্গে বাইরন বিশ্বাসকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে বিঁধেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। বস্তুত, সাগরদিঘিতে জয়ের পর বাম-কংগ্রেস জোট ফলাও করে যে ‘সাগরদিঘি মডেল’-এর প্রচার করেছিল, তা বিশবাঁও জলে।
২০২১ সালে বিধানসভা ভোটে শূন্য হাতে ফিরেছিল কংগ্রেস। শুধু একটি মাত্র আসনে জয়ী হয়েছিল বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট। সেটাও ভাঙড়ে। সৌজন্যে আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকি। সেখান থেকে উপনির্বাচনে প্রথম বিধায়ক পেয়েছিল কংগ্রেস। সাগরদিঘিতে জয়ের পর আত্মবিশ্বাস বাড়ে কংগ্রেসের মধ্যে। মুর্শিদাবাদে দলে দলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা যোগ দেন কংগ্রেসে। বহরমপুরের সাংসদ অধীরের হাত থেকে তাঁরা কংগ্রেসের পতাকা তুলে নিয়েছেন। পঞ্চায়েত ভোটের আগে বাম-কংগ্রেস জোট নিয়ে জল্পনা জোরদার হয়। কিন্তু ৩ মাসেই ছন্দপতন। নাকি স্বপ্নভঙ্গ? সোমবার তৃণমূলে যোগ দিয়ে বাইরন জানালেন, তিনি আসলে তৃণমূলেই ছিলেন!
গত ২ মার্চ সাগরদিঘিতে জয়ের পর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির ভূয়সী প্রশংসা করে বাইরন বলেছিলেন, ‘‘দাদা যে ভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাতেই আমরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি। উনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমার জন্য ভোট চেয়েছেন।’’ পাশাপাশি সিপিএমের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘‘সিপিএম সমস্ত শক্তি দিয়ে এখানে লড়েছে। আমরা নিবিড় যোগাযোগ রেখে প্রচার করেছি। রাজ্য নেতৃত্ব জেলা নেতৃত্বকে ভাল করে লড়তে বলেছিল।’’ কিন্তু সোমবার সেই বাইরন বললেন, ‘‘বরাবরই তৃণমূল করে আসছি। টিকিট পাইনি বলে কংগ্রেসে যাই।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমি কংগ্রেসের ভোটে জিতিনি। আমি আগে থেকে জনগণের কাজ করেছি। তাঁদের ভোটে জিতেছি। আবার ভোট হলে আবার জিতে প্রমাণ করব যে এটা কংগ্রেসের ভোটে জয় নয়।’’ তাঁর জয়ে কংগ্রেসের কোনও অবদান নেই বলে দাবি করে বাইরন প্রশ্ন করেন কংগ্রেস কেন ২০২১ সালে একটি আসনও পায়নি?
বাইরনের কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়ার পর লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে অ-বিজেপি জোটের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। আগামী লোকসভা ভোটে দেশে বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীদের সম্মিলিত প্রার্থী দেওয়া নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। কর্নাটকে কংগ্রেসের জয়ের পর তা আরও জোরদার হয়েছে। বিরোধী জোটের পক্ষে রয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা। অন্য দিকে আছে কংগ্রেস, বামও। আগামী ১২ জুন নীতীশ কুমার, তেজস্বী যাদবের বিহারে এই বিরোধী জোটের গুরুত্বপূর্ণ মহাবৈঠকও বসতে চলেছে। সেখানে মমতা থাকবেন, চেষ্টা হচ্ছে কংগ্রেসকেও আনার। হাত ছেড়ে বাইরনের তৃণমূলে যোগদানের কোনও প্রভাব কি পড়তে চলেছে সেই বৈঠকে? এ নিয়ে অধীরের মন্তব্যকে ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘‘সাগরদিঘির ফলে প্রমাণিত হয়েছে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অপরাজেয় নন। তৃণমূলকেও হারানো যায়।’’
অধীর বলছেন, এক মাঘে শীত যায় না:
বাইরনের দলত্যাগের খবর শোনার পর থেকে ফুঁসছেন অধীর। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি এক দিকে যেমন তৃণমূলের দল ভাঙানোর রাজনীতিকে নিশানা করেন, তেমনই বাইরনকেও তীব্র আক্রমণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘মিরজাফরের থেকেও মানুষের সঙ্গে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন বাইরন।’’ কিছু ক্ষণ বাদে বিধায়ক বাইরনকে ‘নন পলিটিক্যাল’ (অরাজনৈতিক) বলে কটাক্ষ করেছেন অধীর। তিনি এ-ও বলেন, ‘‘মানুষের রায় ছিল বাইরন বিশ্বাস কংগ্রেসের এমএলএ হোক। দিদি ও খোকাবাবুর ইচ্ছে ছিল মানুষের রায়কে পদাঘাত করে এগিয়ে যাব। নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিতে পারেনি তৃণমূল। তাই ভোটের পর বারবার চেষ্টা করে গিয়েছে বাইরনকে তৃণমূলে নিতে। যা যা করেছে তাতে স্পষ্ট হয়েছিল, তৃণমূল এই হারকে মেনে নেবে না।’’ এখানেই থামেননি অধীর। তিনি সরাসরি নিশানা করেছেন মমতা-অভিষেককে। বলেন, ‘‘দিদি যে দল ভাঙানোর খেলায় সিদ্ধহস্ত, তা সারা ভারত জানে।’’ তার পরেই অধীরের হুঁশিয়ারি, ‘‘দিদি, এক মাঘে শীত যায় না! যে খেলা আপনি শুরু করেছেন, মিলিয়ে নেবেন, সেই খেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আপনিই। আর কিছু দিনের মধ্যেই আপনার দল ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে। চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট (গ্রহণ) করলাম। কংগ্রেসকর্মীরা দুঃখ পাবেন না।’’
অধীরের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে অভিষেক:
উপনির্বাচনের আগে এবং পরেও সাগরদিঘি নিয়ে শাসকশিবিরে সবচেয়ে ‘সক্রিয়’ দেখা গিয়েছে অভিষেককে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে জনসংযোগ যাত্রায় বেরিয়ে তিনি সাগরদিঘি-সহ মুর্শিদাবাদে সভা করেছেন। এবং বিভিন্ন সভায় বারংবারই সাগরদিঘির প্রসঙ্গ এনেছেন। সোমবার যে ছবি দেখা গিয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, অভিষেক তথা তৃণমূলের সঙ্গে বাইরনের যোগাযোগ আগেই স্থাপিত হয়েছিল। অভিষেক নিজেই বলেছেন, ‘‘আমার সঙ্গে ওঁর (বাইরনের) যোগাযোগ হয়েছিল। জনসংযোগ যাত্রায় একাধিক বার ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মযজ্ঞ এবং তৃণমূলের মতাদর্শকে সামনে রেখেই উনি তৃণমূলে যোগ দিলেন।’’ পাশাপাশি বাংলায় কংগ্রেস বিজেপিকে সাহায্য করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
বিজেপি বলছে এটাই হওয়ার ছিল:
বাইরনের দলবদলের ঘটনাকে রাজ্য বিজেপি ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ হিসেবে দেখছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদাররা জানাচ্ছেন, এটাই হওয়ার ছিল। তাই তাঁরা বলে আসছেন, বাম এবং কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া মানে সেটা তৃণমূলে চলে যাবে। সুকান্তের কথায়, ‘‘এই উপনির্বাচনে আমি একটি জায়গাতেই প্রকাশ্যে বলেছিলাম কংগ্রেসের যিনি প্রার্থী হয়েছেন, তিনি জেতার পরের দিনই হয়ত তৃণমূলে চলে যাবেন। সেটাই দেখা গেল, বাইরন বিশ্বাস এখন মিরজাফর বিশ্বাস হয়ে গেল। এখন চলবে এরকমই।’’
এক নজরে সাগরদিঘি কেন্দ্র:
১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা বামেদের দখলে ছিল মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি বিধানসভা। ২০১১ সালে ‘পরিবর্তনের ভোট’-এ সাগরদিঘির ভোটে জেতে তৃণমূল। সেই থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাগরদিঘির দখল ছিল তৃণমূলেরই হাতে। কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বরে রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তথা সাগরদিঘির বিধায়ক সুব্রত সাহার মৃত্যুর পর বিধায়কশূন্য হয়ে পড়ে ওই কেন্দ্র। ২৭ ফেব্রুয়ারি ওই কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়। যেখানে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি প্রার্থী করে তৃণমূল ছেড়ে আসা দিলীপ সাহাকে। যিনি ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সাগরদিঘিতে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী হন বাইরন। তিনি জেতেন প্রায় ২৩ হাজার ভোটে।