রাজ্যে পোস্ত চাষের অনুমতি চান মমতা। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
বাঙালির পাতে সস্তায় পোস্ত পৌঁছে দিতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই কারণে রাজ্যে পোস্ত চাষের অনুমতি চেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার বিধানসভায় এ কথা জানিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। বাংলায় কেন পোস্ত চাষ করতে দেওয়া হবে না, তা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন মমতা। এই দাবিতে রাজ্যের বিজেপি বিধায়কেরাও যাতে পাশে দাঁড়ান, সে কথাও বলেছেন তিনি।
শুধু পোস্তর বড়াই নয়, বাটা হোক বা আলুপোস্ত— সবই বাঙালির বড় প্রিয়। কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্য নেই নিয়মিত খাওয়ার। কারণ, এখন দাম কেজি প্রতি মোটামুটি দেড় হাজার টাকা। মাঝে করোনাকালের পরে পরে দাম কেজি প্রতি আড়াই হাজার টাকাও হয়ে গিয়েছিল। দাম বৃদ্ধির পিছনে আরও অনেক কারণ থাকলেও পোস্ত চাষের কড়াকড়িতেই চাহিদার তুলনায় জোগান কম। আর তাতেই বাড়ে দাম।
শুধু ভারতে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও পোস্ত চাষের উপরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকে। কারণ, পোস্তদানা আসলে বীজ। মূল ফলটি থেকে আবার নেশাদ্রব্য আফিম তৈরি হয়। আবার ওই ফলের ভিতর থেকে যে আঠালো তরল বার হয় সেই ‘ল্যাটেক্স গাম’ বিভিন্ন রকম ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে। ক্যানসারের ওষুধ ছাড়াও ব্যথানাশক ওষুধও তৈরিতে লাগে ‘ল্যাটেক্স গাম’। আবার সেই তরল দিয়েই তৈরি হয় নানা রকম মারাত্মক মাদক। কারণ, ব্যথা কমানোর পাশাপাশি স্নায়ুতেও প্রভাব পড়ে। তন্দ্রা আসে। হেরোইনও তৈরি হতে পারে ‘ল্যাটেক্স গ্রাম’ দিয়ে।
গোটা বিশ্বেই পোস্ত চাষে নিয়ন্ত্রণ আনতে এই কারণেই ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ মন্ত্রকের অধীনে থাকা ‘সেন্ট্রাল ব্যুরো অব নার্কোটিকস’ দেশে পোস্ত চাষ নিয়ন্ত্রণ করে। ভারতে ১৯৮৫ সালের নার্কোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্সেস (এনডিপিএস) আইন মেনেই পোস্ত চাষ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেই নিয়মে বলা রয়েছে, অনুমোদিত চাষিদের যাবতীয় উৎপাদন, মানে পোস্তদানা এবং ল্যাটেক্সের সবটাই নার্কোটিক্স কন্ট্রোল বোর্ডকে বিক্রি করতে হবে। এখন ভারতে তিনটি রাজ্যের পোস্ত চাষের অনুমোদন রয়েছে। সেখানেও আবার কতটা জমিতে কতটা পোস্ত চাষ করা যাবে তা-ও নিয়ন্ত্রিত। দেশের চাহিদা পূরণের জন্য চাষের নিম্নসীমাও নির্ধারিত। মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে প্রতি হেক্টর জমিতে ৫৩ কিলোগ্রাম এবং উত্তরপ্রদেশে ৪৫ কিলোগ্রাম পোস্ত উৎপাদন করতে পারেন এমন চাষিরাই অনুমোদন পান। কেউ যদি অনুমোদনের বেশি চাষ করেন কিংবা নির্দিষ্ট পরিমাণে উৎপাদন করতে না পারেন তাদের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়।
ভারতে আবার সব রকমের পোস্ত চাষ করা যায় না। ‘কনসেন্ট্রেটেড পপি স্ট্র’ নামে এক ধরনের পোস্ত থেকে বিশেষ আফিম উৎপাদন করা যায় না। তাই এই প্রজাতির পোস্তই চাষ করতে অনুমতি দেওয়া হয়। প্রতি বছর অক্টোবর মাস নাগাদ অনুমোদন দেওয়া হয়। আর উৎপাদিত পোস্ত ও ল্যাটেক্স বিক্রি করতে হয় এপ্রিল মাসের মধ্যেই। এর পরে গুণমান পরীক্ষা হয়। উত্তরপ্রদেশের গাজিপুর এবং মধ্যপ্রদেশের নিমাচে রয়েছে গবেষণা কেন্দ্র।
এর বাইরে যে পোস্ত চাষ হয় না, তা বলা যাবে না। বাংলাতেও কোনও কোনও জেলায় আইন ভেঙে পোস্ত চাষ হয়। আফিম তৈরির বেআইনি কারখানাও কম নেই। রাজ্য আবগারি দফতর এবং পুলিশ-প্রশাসন মাঝেমাঝেই অভিযান চালিয়ে পোস্ত বাগান নষ্ট করে দেয়। কিন্তু তার পরেও বিভিন্ন জেলায় বেআইনি চাষ চলতে থাকে। কিন্তু ভারত সরকারের এনডিপিএস ১৯৮৫ আইনের ৮(বি) ধারা অনুসারে, কেউ যদি সরকারি ছাড়পত্র ছা়ড়া পোস্ত চাষ করে তবে তো বটেই, এমনকি পোস্ত মজুত করে রাখা, বহন করা এবং বিক্রি করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
রাজ্যে বেআইনি পোস্ত চাষের রমরমা রুখতে অনেকটাই সক্রিয় প্রশাসন। তবে বাজারে দামবৃদ্ধির এটাও একটা কারণ যে ভারতে বড় পরিমাণে পোস্ত আফগানিস্তান থেকে আমদানি করা হয়। আর আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপরে নির্ভর করে সেই আমদানি। যা কমলেই দাম বেড়ে যায় হু হু করে। এই পরিস্থিতিতেই বাংলায় যাতে পোস্ত চাষের অনুমোদন দেওয়া হয় সেই দাবি তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ২০২০ সালে ভুবনেশ্বরে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির (ইস্টার্ন জ়োনাল কাউন্সিল) বৈঠকের সময় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে এই বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে তার পরও এই নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। এখন ফের সরব মমতা।