দমদম বিমানবন্দরে বৃহস্পতিবার বাজেয়াপ্ত রহস্যে মোড়া পাথরখণ্ডগুলির একটি। - নিজস্ব চিত্র।
ঘনীভূত হচ্ছে পাথর-রহস্য! দমদম বিমানবন্দরের বাইরে বৃহস্পতিবার দুই ব্যক্তির কাছ থেকে সিআইডি-র বাজেয়াপ্ত করা ছাই রঙের পাথরখণ্ডগুলি কি সত্যিই অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় মৌল ক্যালিফোর্নিয়াম? নাকি অন্য কিছু? সিআইডি সূত্রে খবর, ধৃত ব্যক্তিরা জেরায় স্বীকার করেছেন উদ্ধার হওয়া পাথরগুলি ক্যালিফোর্নিয়াম। যাঁরা বাজেয়াপ্ত করেছেন পাথরখণ্ডগুলি, সেই সিআইডি-র গোয়েন্দারা কিন্তু এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি এই ব্যাপারে। পাথরখণ্ডগুলিকে পরীক্ষা করতে পাঠানো হয়েছে মুম্বইয়ের ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার (বার্ক)-এ। তাদের রিপোর্ট পেলেই বোঝা যাবে পাথরখণ্ডগুলি কতটা ভয়াবহ।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই পাথরগুলি ক্যালিফোর্নিয়াম হলে সেগুলি মৌলটির কোনও ‘আইসোটোপ’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। প্রশ্ন উঠছে, ক্যালিফোর্নিয়ামের আইসোটপ হলে তা কতটা ক্ষতিকারক আমাদের পক্ষে?
মাদাম ক্যুরি ও তেজস্ক্রিয় মৌল
তেজস্ক্রিয় মৌল হিসাবে ইউরেনিয়ামের জনপ্রিয়তা সর্বাধিক। পরমাণু বোমা ও পারমাণবিক প্রযুক্তির কল্যাণে। কিন্তু শুধুই তো ইউরেনিয়াম নয়, এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার করা গিয়েছে এমন মোট ৩৮টি তেজস্ক্রিয় মৌল রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম রেডিয়াম। ১৮৯৮ সালে মাদাম ক্যুরি আর তাঁর স্বামী পিয়ের ক্যুরি যা আবিষ্কার করেছিলেন রেডিয়ামের একটি যৌগ থেকে। আচমকা। কিন্তু দেখা গেল, বিশুদ্ধ রেডিয়াম স্থায়ী হচ্ছে না মোটেও। বাতাসের সংস্পর্শে এলেই হুশ করে বদলে যাচ্ছে অন্য পদার্থে। ভেঙে যাচ্ছে অন্য স্থায়ী পদার্থে। রেডিয়ামের সূত্রেই প্রথম জানা যায়, মৌল তেজস্ক্রিয়ও হতে পারে।
তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ভয়াবহতা
অত্যন্ত ক্ষতিকারক তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটিয়ে কোনও অস্থায়ী মৌল কিছু ক্ষণের মধ্যেই স্থায়ী মৌলে বদলে যায়। সেই বিকিরণগুলির মধ্যে আছে আলফা কণা, বিটা কণা, নিউট্রন কণা আর গামা রশ্মি। বিকিরণগুলির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও ক্ষতিকারক গামা রশ্মি। সবচেয়ে কম ক্ষতিকারক আলফা কণার বিকিরণ। তা আমাদের ত্বক ফুঁড়ে শরীরের ভিতরে ঢুকতে পারে না। বাকি বিকিরণগুলি শরীরে ঢুকে দেহকোষের ক্ষতি করতে পারে। ডেকে আনতে পারে মৃত্যুও।
৩৮টি তেজস্ক্রিয় মৌল
হাইড্রোজেন মৌলকে এক নম্বরে রেখে শুরু হওয়া মেন্ডেলিয়েভের পর্যায় সারণীর পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম পর্যায়ে রাখা আছে ৩৮টি তেজস্ক্রিয় মৌলকে। একের পর এক, তাদের পরমাণুগুলির কেন্দ্রে থাকা ধনাত্মক কণা প্রোটনের সংখ্যার নিরিখে। সেই নিরিখে ইউরেনিয়াম রয়েছে পর্যায় সারণীর ৯২ নম্বর স্থানে, রেডিয়াম ৮৮-তে আর ক্যালিফোর্নিয়াম রয়েছে ৯৮ নম্বরে।
বিশুদ্ধ ক্যালিফোর্নিয়াম প্রকৃতিতে নেই, থাকতে পারেও না
অ্যাক্টিনাইড গোত্রের যে তেজস্ক্রিয় মৌলগুলিকে রাখা আছে পর্যায় সারণীতে একের পর এক, তাতে ইউরেনিয়াম থেকে শুরু করে ষষ্ঠতম জায়গাটি দখলে আছে ক্যালিফোর্নিয়াম মৌলের। বিশুদ্ধ ক্যালিফোর্নিয়াম মৌল কখনওই প্রকৃতিতে পাওয়া সম্ভব নয়। মৌলটি কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা হয়েছিল ১৯৫০ সালে বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে। সে জন্যই তার নাম ক্যালিফোর্নিয়াম। তেজস্ক্রিয় মৌল ক্যুরিয়াম-এর (মাদাম ক্যুরির নামে নামকরণ) উপর আলফা কণাদের আছড়ে ফেলে।
কী ভাবে উধাও হয় তেজস্ক্রিয় মৌল?
সব তেজস্ক্রিয় মৌলের মতো ক্যালিফোর্নিয়ামও একটি নির্দিষ্ট সময় পরে উধাও হয়ে যায়। আর প্রকৃতিতে থাকে না। থাকতে পারে না। উধাও হওয়ার সময় খুব ক্ষতিকারক নানা ধরনের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটায়। সেই উধাও হওয়ারও আবার নির্ধারিত সময়সীমা আছে। তাকে বলে ‘হাফ লাইফ’ বা অর্ধায়ু। কোনও তেজস্ক্রিয় মৌলের ক্ষেত্রে সেটা কিছুটা বেশি, কারও ক্ষেত্রে আবার তা কয়েক সেকেন্ড। হাফ লাইফে পৌঁছনোর পর সব তেজস্ক্রিয় মৌলেই ভরে ও আয়তনে অর্ধেক হয়ে যায়। তখন তার অর্ধেক অংশ তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটিয়ে অন্য কোনও স্থায়ী মৌলে বদলে যায়। বাকি অংশটি অপেক্ষা করে বিকিরণ ঘটিয়ে অন্য কোনও স্থায়ী মৌলে বদলে যাওয়ার জন্য।
রহস্যে মোড়া সেই পাথরখণ্ড। -নিজস্ব চিত্র।
আইসোটোপ: নামে-ধামে এক, চেহারা অন্যরকম
কিন্তু নামে (পর্যায় সারণীতে মৌলগুলির স্থান) ধামে এক হলেও প্রায় সব মৌলেরই থাকে নানা রূপ। তাদের বলা হয় ‘আইসোটোপ’। সাধারণ মৌলের যেমন নানা আইসোটোপ থাকে, তেমনই নানা রকমের আইসোটোপ থাকে তেজস্ক্রিয় মৌলেরও। তাদের ক্ষেত্রে নামটা তখন একটু বদলে গিয়ে হয় ‘রেডিয়ো আইসোটোপ’। কোনও মৌলের পরমাণুর কেন্দ্রে থাকা নিউট্রন সংখ্যার তারতম্যেই তৈরি হয় সেই মৌলের নানা রকমের আইসোটোপ।
হাইড্রোজেনের আইসোটোপ আছে বলেই তার একটি যৌগ জলও হয় দু’রকমের। সাধারণ জল আর ভারী জল। অক্সিজেনের সঙ্গে হাইড্রোজেনের কোন আইসোটোপ হাত মেলাচ্ছে তার ভিত্তিতে।
২০টি আইসোটোপ ক্যালিফোর্নিয়ামের!
তেজস্ক্রিয় মৌল ক্যালিফোর্নিয়ামেরও আছে তেমন মোট ২০টি আইসোটোপ। ক্যালিফোর্নিয়াম পরমাণুর কেন্দ্রে থাকা ২৩৭টি নিউট্রন থেকে শুরু করে ২৫৬টি নিউট্রন কেন্দ্রে থাকা ক্যালিফোর্নিয়াম পরমাণু পর্যন্ত।
তবে ক্যালিফোর্নিয়াম মৌলটি যেহেতু ছিলই না প্রকৃতিতে, তাকে বানানো হয়েছিল কৃত্রিম ভাবে, তাই তার কোনও আইসোটোপই স্থায়ী হতে পারে না। কোনওটা একটু আগে উধাও হয়ে যাবে, কোনওটা একটু পরে।
আড়াই বছর থেকে ৮৯৮ বছর!
তেজস্ক্রিয় মৌলের অর্ধায়ুর নিরিখে কৃত্রিম ভাবে গবেষণাগারে বানানো ক্যালিফোর্নিয়াম মৌলটির আইসোটোপগুলির মধ্যে সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী ২৩৭টি নিউট্রন কেন্দ্রে থাকা পরমাণুটি। মাত্র ২ সেকেন্ড। অর্ধায়ু সবচেয়ে বেশি ২৫২টি নিউট্রন কেন্দ্রে থাকা পরমাণুটির। ৮৯৮ বছর।
কলকাতায় উদ্ধার পাথরগুলি ক্যালিফোর্নিয়ামের কোনও আইসোটপ হলে তা কতটা ক্ষতিকারক?
গবেষণাগার ছাড়া যে মৌলের অস্তিত্ব বিশুদ্ধ অবস্থায় প্রকৃতিতে অসম্ভব, তা দমদম বিমানবন্দরে বৃহস্পতিবার সিআইডি-র হাতে গ্রেফতার হওয়া দু’জন পেলেন কী ভাবে? এই ঘটনা বোঝাচ্ছে, পাথরখণ্ডগুলি বিশুদ্ধ ক্যালিফোর্নিয়াম মৌল হতে পারে না। তা হয়তো পাথরগুলিতে কোনও যৌগ হিসাবে রয়েছে। সেই অজানা যৌগ ক্যালিফোর্নিয়ামের কোন আইসোটোপ দিয়ে তৈরি হয়েছে, তা জানতে পারলেই বোঝা সম্ভব হবে তাদের স্থায়িত্ব কতটা বা সেগুলি আমাদের পক্ষে কতটা বিপজ্জনক।