গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
রবিবার গোটা দিন জুড়েই চর্চায় থাকল রাজ্যের দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। অন্যটি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমটি রাজ্য সরকারের আওতাধীন। আর দ্বিতীয়টি কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত। একই দিনে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি অনুষ্ঠানের আয়োজনে রাজ্য প্রশাসনের ভূমিকা বিভিন্ন মহলে আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের নিরিখে রাজ্য সরকারের কার্যত এই ‘মাস্টারি’কে ‘অভূতপূর্ব’ বলেই মনে করছেন অনেকে।
স্মরণযোগ্য কালের ইতিহাস বলছে, রাজ্য সরকার পরিচালিত হলেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই ‘নিজের মতো’ করে চলেছে। বাম আমলের সেই ‘ধারা’ বজায় থাকতে দেখা গিয়েছে তৃণমূল জমানাতেও। বিশ্ববিদ্যালয়েরই একাংশের মত, প্রশাসনিক পদে সরকার এবং শাসকদলের ‘ঘনিষ্ঠ’ ব্যক্তিরা থাকলেও কখনওই কোনও সিদ্ধান্ত একক ভাবে যাদবপুরের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায়নি। সরকারি সিদ্ধান্ত অপছন্দ হলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রতিরোধ’ হয়েছে। পরে পড়ুয়া, শিক্ষক-সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত নিয়েই কোনও সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি রাজ্যপাল তথা আচার্য সিভি আনন্দ বোস একক ভাবে অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নিজেদের ‘প্রভাব’ হারাতে বসেছিল রাজ্য সরকার। তারা চাইলেও শুধুমাত্র রাজভবনের ‘বাধাদানে’ বাতিল হয়ে যাচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানও। বিবাদ এতটাই তুঙ্গে ওঠে যে, অন্তর্বর্তী উপাচার্য হিসাবে নিজে যাঁকে নিয়োগ করেছিলেন, তাঁকেও আচমকাই সরিয়ে দিয়েছেন বোস। কিন্তু শেষমেশ রবিবার নির্ধারিত দিনেই সেই অনুষ্ঠান হল। এবং তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে দেখা গেল রাজ্য প্রশাসনকে।
একই ঘটনা ঘটেছে বিশ্বভারতীতেও। তারা বরাবর পূর্বপল্লির মাঠে শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যবাহী পৌষমেলার আয়োজন করে এসেছে। কিন্তু গত তিন বছর ধরে তা বন্ধ। অতিমারির যুক্তি দেখিয়ে তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন প্রাক্তন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। গণ আবেগ, স্থানীয় অর্থনীতি ও ঐতিহ্যের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে ওই তিন বছর বিকল্প পৌষমেলার আয়োজন করেছিল জেলা প্রশাসন। বিশ্বভারতী রাজি না থাকায় সেই মেলা হয়েছিল ডাকবাংলোর মাঠে। কিন্তু এ বার সেই মেলা জেলা প্রশাসনকে পূর্বপল্লির নিজস্ব প্রাঙ্গণেই করার অনুমতি দিয়েছে বিশ্বভারতী। রবিবার প্রথম বার এই মেলার উদ্বোধন করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘কোনও স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে বিশ্বভারতী চালালে হবে না।’’ বিদ্যুৎ-পর্বের পর এই ঘটনাকে এক রকম ভাবে রাজ্য সরকারেরই ‘জয়’ হিসাবে দেখছেন বিশ্বভারতীর অনেকে!
দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দু’টি ঘটনার মধ্যে একটি মিল রয়েছে। তা হল কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ। ‘কেন্দ্রের দূত’ রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিবাদ চরমে উঠেছিল মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ ঘিরে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো যাদবপুরেও অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগ করেছিলেন রাজ্যপাল বোস। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক বুদ্ধদেব সাউকে উপাচার্য পদের দায়িত্ব দিয়েছিল রাজভবন। তা নিয়ে রাজ্যের সঙ্গে বিবাদ সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। সেই আবহে সমাবর্তন অনুষ্ঠান নিয়ে জট তৈরি হয় বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতি বছর ২৪ ডিসেম্বর যাদবপুরে সমাবর্তন হয়। নীতি মেনে সমাবর্তনের জন্য যাদবপুরে প্রতি বছর কোর্টের বৈঠক করতে হয়। তার জন্য প্রয়োজন হয় আচার্য তথা রাজ্যপালের অনুমতি। কিন্তু এ বছর আইনি জটিলতার কারণ দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্টের বৈঠকে অনুমতি দেননি বোস। তার পর থেকেই সমাবর্তন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। কিন্তু উচ্চশিক্ষা দফতরের সবুজ সঙ্কেত এবং কর্মসমিতির সম্মতিতে সমাবর্তন করায় উদ্যোগী হয়েছিলেন বুদ্ধদেব। যদিও কিন্তু শুক্রবার তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতি সম্প্রতি সমাবর্তন হওয়ার দিকেই মত দিয়েছে। সেই মতোই সমাবর্তন হবে। বিষয়টি রাজভবনকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় রাজ্য শিক্ষা দফতর। রাজ্যপালের একক মনোনীত প্রার্থী হওয়ায় বুদ্ধদেব শুরুতে উচ্চ শিক্ষা দফতরের ‘সুনজরে’ ছিলেন না। কিন্তু সমাবর্তন-জটে রাজ্যপাল ও বুদ্ধদেবের মধ্যে মতানৈক্য প্রকাশ্যে চলে আসে। তার পরেই শনিবার অন্তর্বর্তী উপাচার্য বুদ্ধদেবকে সরিয়ে দেয় রাজভবন। তার পরেও সমাবর্তন নিয়ে জট জিইয়ে ছিল।
কিন্তু রবিবার রাজ্যপাল তথা আচার্যকে উপেক্ষা করেই যাদবপুরে বার্ষিক সমাবর্তন হল। এবং এর জন্য বিশেষ ভূমিকা নিতে দেখা গেল রাজ্য সরকারকেই। শুধুমাত্র রবিবারের জন্যই উপাচার্যকে বিশেষ ক্ষমতা দেয় রাজ্যের শিক্ষা দফতর। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২০২৩ সালের ১৭ অগস্ট বুদ্ধদেবকে উপাচার্য পদে বসানো হয়েছিল। উপাচার্যের কর্তব্য পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ২৩ ডিসেম্বর, শনিবার আচমকা সেই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। অথচ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, রাজ্যপাল তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য একক ভাবে এ ধরনের কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তার পরেই ২৪ ডিসেম্বর সমাবর্তন করানোর জন্য বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয় বুদ্ধদেবকে। এর পরেই রবিবার কোর্টের বৈঠক ডাকা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও বৈঠকের পর সহ-উপাচার্য অমিতাভ দত্তকে সামনে রেখেই সমাবর্তন হয় যাদবপুরে। তিনিই পড়ুয়াদের হাতে শংসাপত্র তুলে দেন। তবে তাঁর পাশেই বসে ছিলেন সদ্য ‘অপসারিত’ উপাচার্য বুদ্ধদেব। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশের মত, রাজ্যপাল বেঁকে বসায় সমাবর্তন নিয়ে এত জটিলতা তৈরি হয়। রাজ্য সরকার এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা না করলে হয়তো তা সম্ভব হত না।
একই ভাবে, বিশ্বভারতীর সঙ্গে দীর্ঘ টানাপড়েনের পর সেই পূর্বপল্লির মাঠেই পৌষমেলার আয়োজন করেছে জেলা তথা রাজ্য প্রশাসন। রবিবার মেলার উদ্বোধনের আগে ছাতিমতলায় বিশেষ গানের মধ্য দিয়ে পৌষ উৎসবের সূচনা করেন বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সঞ্জয়কুমার মল্লিক। ছাতিমতলা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘উদয়ন’ বাড়ি পর্যন্ত পদযাত্রাও হয়। তার পর পৌষমেলার ভার্চুয়াল উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভোলায় রে— এই গানটি আজও আমাদের কাছে সমাদৃত এবং বিশ্বজনীন। বিশ্বের প্রতি কবিগুরুর অবদান রয়েছে।” মমতার সংযোজন, ‘‘কেউ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই স্থানকে কলুষিত করুক আমরা সেটা চাই না। তাই ভালবাসার সঙ্গে, সতর্কতার সঙ্গে এই মেলা পরিচালনা করতে হবে।’’
২০২০ সালে করোনা-পর্বে পূর্বপল্লির মাঠে পৌষমেলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন প্রাক্তন উপাচার্য বিদ্যুৎ। সাম্প্রতিক অতীতে মেলা পরিচালনা করতে গিয়ে কিছু আইনি জটিলতায় বিদ্ধ হয়েছিল বিশ্বভারতী। যার মূলে ছিল নির্দিষ্ট দিনে মেলা শেষ করা, কঠিন বর্জ্য নিষ্কাশন করা। এই ধরনের নানা অসুবিধা দেখিয়ে পরের দু’বছরও পৌষমেলার আয়োজন করেনি বিশ্বভারতী। যার জেরে ক্ষতির মুখে পড়তে হয় বহু ব্যবসায়ীকে। জেলা প্রশাসন ‘বিকল্প পৌষমেলা’ করেছে ঠিকই। কিন্তু, ব্যবসায়ীদের একাংশের কথায়, তা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো! এ বার পৌষমেলা আয়োজনের আগেই বিদ্যুতের উপাচার্য পদের মেয়াদ শেষ হতেই আশার আলো দেখতে শুরু করেছিলেন তাঁরা। এ বার বিশ্বভারতীও শুরুতে জানিয়েছিল, পৌষমেলা হবে। কিন্তু পরিবেশ আদালতের নির্দেশ মেনে মেলা হবে ছোট আকারে। তার অব্যবহিত পরে মেলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট জানিয়ে দেয়, এত কম সময়ের মধ্যে মেলার আয়োজন সম্ভব নয়। তা ছাড়া ছোট আকারেও মেলা করা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বভারতীও জানিয়ে দেয়, পৌষমেলা হচ্ছে না। এর পর মেলার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতি। শেষমেশ বিকল্প পৌষমেলা করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় জেলা প্রশাসন।
পৌষমেলার আয়োজনে জেলা প্রশাসনের সক্রিয় যোগদান নতুন নয়। এ বার তফাত— এই মেলার আয়োজক জেলা প্রশাসন নিজেই। জেলা পুলিশের তরফেও পথনির্দেশ সংবলিত মানচিত্র বা গাইড ম্যাপ প্রকাশ করা হয়। অনেকের মতে, শান্তিনিকেতনের মাঠে, পরিবেশ আদালতের নির্দেশ ও বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য অনুসরণে এ বছর পৌষমেলার আয়োজন যেন একটা নতুন ‘মডেল’-এর পরীক্ষা। যার উপর ভবিষ্যতে আবার এই মাঠে পৌষমেলা হবে কি না, তা নির্ভর করছে। জেলা প্রশাসনও যে এই মডেল সফল করতে উৎসাহী, তা জেলাশাসকের কথাতেই স্পষ্ট। জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, “রবীন্দ্র স্মৃতি-বিজড়িত এই মেলাকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর করতে আমরা প্রস্তুত। আশা করছি সুষ্ঠুভাবে মেলা পরিচালিত হবে।’’