গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ-দুর্নীতি মামলায় আপাতত অনুসন্ধান শুরু করতে পারছে না সিবিআই। এ ব্যাপারে কলকাতা হাইকোর্টের একক বেঞ্চ যে রায় দিয়েছিল, তাতে তিন সপ্তাহের জন্য স্থগিতাদেশ দিল ডিভিশন বেঞ্চ।
স্কুলে গ্রুপ-ডি বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগ মামলায় সিবিআইয়ের হাতে প্রাথমিক তদন্ত ভার বা অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্টের একক বেঞ্চ। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যায় রাজ্য, স্কুল সার্ভিস কমিশন ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। বুধবার বিচারপতি হরিশ টন্ডন ও বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সামন্তর ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত শুনানির প্রয়োজন। তাই তিন সপ্তাহের জন্য ওই নির্দেশ স্থগিত থাকবে। এখন এসএসসি ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদকে সমস্ত তথ্য মুখবন্ধ খামে আদালতের কাছে জমা দিতে হবে। একক বেঞ্চের নির্দেশ মোতাবেক যা সিবিআইয়ের কাছে জমা দেওয়ার কথা ছিল।
মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগ হয়েছে এই অভিযোগ তুলে মামলা দায়ের হয় কলকাতা হাই কোর্টে। সেই মামলায় সিবিআইয়ের হাতে প্রাথমিক তদন্ত বা অনুসন্ধানের ভার কলকাতা হাই কোর্ট দিয়েছিল সোমবার। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের একক বেঞ্চ জানিয়েছিল, স্কুল সার্ভিস কমিশন ও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের হলফনামায় স্পষ্ট যে, স্কুলের গ্রুপ-ডি কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ছািল না। শুধু তা-ই নয় ওই নিয়োগের সঙ্গে আর্থিক বিষয়ও জড়িত। বেঞ্চ বলে, যে দু’টি সংস্থা বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, সে-দু’টিই রাজ্যের। তাই মামলাটির অনুসন্ধান করবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। বুধবার বিচারপতি টন্ডন বলেন, ‘‘কমিশন ও পর্ষদ বলছে তারা ওই নিয়োগে জড়িত নয়। তবে কে ওই সুপারিশ করল তা জানা দরকার।’’ এর পরই রাজ্যের কৌঁসুলি সিবিআই তদন্ত স্থগিত করার আবেদন করেন।
রাজ্যের কৌঁসুলি আদালতে বলেন, ‘‘রাজ্যের যে কোনও নিরপেক্ষ সংস্থা দিয়ে তদন্ত হোক।’’ পর্ষদের আইনজীবীও বলেন, ‘‘আমরা চাই আমাদের একটা সুযোগ দেওয়া হোক। কী ভাবে ওই নিয়োগ হয়েছে তা খুঁজতে শিক্ষা দফতরের উচ্চপদস্থ আধিকারিক দিয়ে তদন্ত করব।’’ এরপর কমিশনের কাছে আদালত জানতে চায়, কেন তারা সিবিআইয়ের বিপক্ষে? উত্তরে কমিশনের আইনজীবী কিশোর দত্ত বলেন, ‘‘আমরা কোনও তদন্তের বিপক্ষে নই। আমাদের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে ওই সুপারিশ করা হয়নি। অন্য কোথাও থেকে তা হলে জানার জন্য অভ্যন্তরীণ তদন্ত করতে চাই। আমাদের দুই বা তিন সদস্যের একটি কমিটি গড়ে অভ্যন্তরীণ তদন্তের অনুমতি দেওয়া হোক। রাজ্য, পর্ষদ এবং কমিশনের আর্জি মেনে নেয় কলকাতা হাই কোর্টেের ডিভিশন বেঞ্চ। একক বেঞ্চের নির্দেশ অনুসারে বৃহস্পতিবার থেকেই তদন্তের ভার নেওয়ার কথা ছিল সিবিআই-এর। আপতত ওই নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ দিল ডিভিশন বেঞ্চ। আদালত জানিয়েছে, এই মামলায় আরও বিস্তারিত শুনানি প্রয়োজন। তাই তিন সপ্তাহের জন্য সিবিআই নির্দেশ স্থগিত থাকবে।
ডিভিশন বেঞ্চের ওই পর্যবেক্ষণে অবশ্য আপত্তি জানান মামলাকারীদের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘তদন্তে স্থগিত করে দিলে তথ্যপ্রমাণ লোপাট হতে পারে। এর আগেও এমন উদাহরণ রয়েছে। নারদ মামলার ক্ষেত্রেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে। রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে তথ্য লোপাটের অভিযোগ উঠেছিল।’’ তাঁর ওই আর্জি পরেই বিচারপতিরা নির্দেশ দেন, সিবিআইকে যে তথ্য কমিশন ও পর্ষদের দেওয়ার কথা ছিল, সেই তথ্য তারা আদালতে জমা দেবে। মুখবন্ধ খামে হাই কোর্টের রেজিস্টার জেনারেলের কাছে জমা দিতে ওই তথ্য। এই মামলার পরবর্তী শুনানি আগামী সোমবার।
এর আগে একক বেঞ্চে শুনানিতে কমিশন ও পর্ষদের কাছে হলফনামা চেয়েছিল আদালত। হলফনামায় পর্ষদ জানিয়েছিল, কমিশনের সুপারিশ মেনেই তারা সমস্ত নিয়োগ করেছে। এমনকি সেই নথিও তারা দিতে প্রস্তুত। অন্য দিকে, কমিশন দাবি করে, বেআইনি ভাবে যে সব নিয়োগের কথা বলা হচ্ছে তাতে তাদের কোনও হাত নেই। কমিশনের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে ওই নিয়োগের কোনও সুপারিশ করা হয়নি। এমনকি তারা ওই বিষয়ে অবগতও নয়। সেখানেই প্রশ্ন ওঠে তবে কি কমিশনের আঞ্চলিক অফিস থেকে ওই দুর্নীতি হয়েছে? যদি তা হয়, সেক্ষেত্রে তার নেপথ্যে আর্থিক এবং প্রভাবশালী যোগ রয়েছে বলে নিজের পর্যবেক্ষণে জানায় আদালত। তার পরই একক বেঞ্চের বিচারপতি দুর্নীতির বীজ খুঁজতে সিবিআইকে দায়িত্ব দেয়। তবে একক বেঞ্চ বলেছিল তদন্ত শুরু করলেও এখনই কাউকে গ্রেফতার বা কারও বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করতে পারবে না সিবিআই। ২১ ডিসেম্বর সিবিআইকে প্রাথমিক রিপোর্ট আদালতে জমা দিতে হবে। তার পর পরবর্তী পদক্ষেপ করবে আদালত। তবে রাজ্যে শিক্ষায় দুর্নীতি হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার ভার যে সিবিআই-এর হাতেই তা স্পষ্ট করে দিয়েছিল হাই কোর্টের একক বেঞ্চ। এই রায়ের বিরুদ্ধেই ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়ার কথা ভাবে রাজ্য।সেই নির্দেশকেই চ্যালেঞ্জ করেছিল রাজ্য, পর্ষদ ও কমিশন।
প্রসঙ্গত, আদালতে সিবিআই অনুসন্ধানের বিরুদ্ধে রাজ্যের অ্য়াডভোকেট জেনারেল সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের যুক্তি ছিল, "খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ক্ষেত্রেই সিবিআই হয়! অথচ এক্ষেত্রে সরাসরি সিবিআইয়ের হাতে অনুসন্ধানের দায়িত্ব চলে গেল! রাজ্য পুলিশের উপর ভরসা করা হল না। সুপ্রিম কোর্টের মতে তদন্ত ও অনুসন্ধানের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আমারও বলছি তদন্ত হোক। আদালতের নজরদারিতে হোক। এই তদন্তের জন্য আদালত পছন্দ মতো পুলিশ অফিসার নিয়োগ করুক। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দিয়ে তদন্ত হলেও আমাদের আপত্তি নেই।"