আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে ‘নরমে-গরমে’ কৌশল নিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। —ফাইল চিত্র।
ইংরেজিতে বলা হয়, ‘গুড কপ-ব্যাড কপ’। বাংলায় ‘নরমে-গরমে’। আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে সেই কৌশলই নিয়েছে শাসক তৃণমূল। এক দিকে প্রশাসন বার বার আলোচনার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্য দিকে, শাসকদলের একাধিক মুখপাত্র আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছেন। যা তুঙ্গে উঠেছে সোমবার বিকেলে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জুনিয়ার ডাক্তারদের বৈঠকের আগে। সেই ‘স্নায়ুযুদ্ধে’ আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা আবার বাড়তি মাত্রা দিয়েছেন ‘আমরণ অনশন’ জারি রেখে।
আরজি কর-কাণ্ডে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন নিয়ে সরকার যে ‘নমনীয়’, নবান্নের তরফে বার বার সেই বার্তা দেওয়া হয়েছে। যার শুরু হয়েছিল তখনই, যখন আন্দোলনের মাসখানেক অতিবাহিত হওয়ার পরে স্বাস্থ্যভবনের সামনে ডাক্তারদের অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। তিনিই প্রথম আলোচনার দরজা খুলে দেন। তাঁর কালীঘাটের বাড়িতে দীর্ঘ বৈঠক হয়। সেই বৈঠকেই কলকাতার পুলিশ কমিশনার-সহ চার সরকারি আধিকারিককে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও আন্দোলন থামেনি। বরং স্বাস্থ্যসচিবকে সরানো-সহ ১০ দফা দাবিতে আবার আন্দোলন শুরু হয়। যা আপাতত এসে দাঁড়িয়েছে ‘আমরণ অনশনে’।
সেই আবহেই সোমবারের বৈঠক। যে বৈঠকের আগে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তিনি চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ‘কড়া পদক্ষেপ’ করতে চাইছেন না। কিন্তু সেই বৈঠকের প্রাক্কালেই শাসকদলের নেতা কুণাল ঘোষ আবার তোপ দেগেছেন। জুনিয়র ডাক্তারেরা যখন বলছেন তাঁরা নবান্নের বৈঠক নিয়ে ‘আশাবাদী’, তখন কুণাল সমাজমাধ্যমে আক্রমণাত্মক পোস্ট করেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা বৈঠক যদি পরিকল্পিত ভাবে অন্যায্য জেদে ভেস্তে দিয়ে মঙ্গলবার স্বাস্থ্য ধর্মঘটের নামে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা হয়, তা হলে বাংলার কোনও রোগীর ক্ষতি হলে নিকটবর্তী থানায় যেন দেবাশিস হালদার, অনিকেত মাহাতোর নামে এফআইআর করা হয়। তাঁরাই চক্রান্তের মাতব্বর। তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং চিকিৎসকের নামও যোগ করবেন। চিকিৎসা আপনার মৌলিক অধিকার। প্ররোচনা দিয়ে তা থেকে বঞ্চিত করা আইনত অপরাধ।’’
অর্থাৎ, বৈঠকের আগে কুণাল ডাক্তারদের ‘চাপে’ রাখতে চেয়েছেন। যে ‘কৌশল’ তিনি ধারাবাহিক ভাবে নিয়ে আসছেন। কুণাল আরও লিখেছেন, অনশনরত কোনও চিকিৎসকের ক্ষতি হলেও তার ‘দায়’ দেবাশিস, অনিকেতদের। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বরাবর অভিভাবকোচিত সংবেদনশীলতা দেখাচ্ছেন। তাতে সাড়া দিয়ে অনশন প্রত্যাহার করে আলোচনা হোক। বাম, অতিবাম, বিরোধীদের ফাঁদে পা দেবেন না।’’
কুণালের মতোই ‘আমরণ অনশন’ নিয়ে আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখিয়েছিলেন তৃণমূলের মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী। অনশন আন্দোলনকে তিনি ‘জিম’ করে সুঠাম হওয়ার নিদান হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। তাতে কিছু সমালোচনাও হয়েছিল। তৃণমূলের এক মুখপাত্র আবার জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মাওবাদীদের তুলনা করে বসেছেন। তাঁর সরলীকরণ, ‘‘মাওবাদীরাও মানুষ মারে। জুনিয়র ডাক্তারেরাও রোগীদের চিকিৎসা না-করে তাঁদের মেরে ফেলছেন!’’
লক্ষণীয়, সরকারের তরফে কিন্তু এমন কোনও ‘আক্রমণাত্মক’ মন্তব্য করা হয়নি। বরং মুখ্যমন্ত্রী বার বারই বলেছেন, তিনি আন্দোলনকারীদের ‘দিদির মতো’। মুখ্যসচিব মনোজ পন্থকে দেখা গিয়েছে, অনশনমঞ্চে আলোচনা করতে গিয়ে সস্নেহে আন্দোলনকারী বা অনশনকারীদের পিঠে হাত রেখে কথা বলছেন।
সেই আবহেই জুনিয়র ডাক্তারেরা কুণালের কোনও বক্তব্যকে ‘গুরুত্ব’ দিতে রাজি হননি। তাঁর সঙ্গে সিনিয়র চিকিৎসক নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মধ্যস্থতা বৈঠক’ও আন্দোলনকারীরা ভাল চোখে দেখেননি। তবে কুণালকে ডাক্তারেরা গুরুত্ব দিতে না চাইলেও তিনি কিন্তু থামেননি। কটাক্ষ এবং আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছেন। চিকিৎসকেরাও পাল্টা মমতার আবেদন এবং অনুরোধ সত্ত্বেও ‘আমরণ অনশন’ না তুলে স্নায়ুর চাপ বজায় রেখেছেন। লক্ষণীয়, আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের কুণালও বারংবার আবেদন জানিয়েছেন অনশন তুলে নেওয়ার জন্য।
বস্তুত, আন্দোলনকারীরা মনে করেন, অনশন না-তোলায় স্নায়ুযুদ্ধের প্রথম রাউন্ডে খানিকটা পিছিয়ে থেকেই নবান্নের বৈঠক শুরু করছে সরকার। সাধারণত যে কোনও ‘সংঘাত’-এর পরিস্থিতিতে কোনও একটি পক্ষকে ‘নমনীয়তা’ দেখাতে হয়। আন্দোলনকারীদের একাংশ মনে করছেন, সেটা মুখ্যমন্ত্রীরই দেখানো উচিত। কারণ, এই সংঘাতে তিনিই বেশি ‘শক্তিধর’। আবার প্রশাসনের একাংশের তরফে বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই যথেষ্ট ‘নমনীয়’ মনোভাব দেখিয়েছেন। তিনি জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি মেনে কলকাতার পুলিশ কমিশনার, কলকাতা পুলিশের এক জন ডিসি এবং স্বাস্থ্য দফতরের দুই আধিকারিককে সরিয়ে দিয়েছেন। যার ফলে বার বার এটা প্রমাণিত হচ্ছে যে, তিনি সমস্যা সমাধানে ‘আন্তরিক’। সোমবারের বৈঠকটিও তিনিই আহ্বান করেছিলেন।
আরজি করের ঘটনার পর থেকে গত দু’মাসে একাধিক বার ডাক্তারদের পক্ষে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বিস্ফোরণ দেখা গিয়েছে। ‘মেয়েদের রাত দখল’ কর্মসূচি থেকে শুরু করে শহরের বুকে কয়েক কিলোমিটারের মানববন্ধন— বিচারের দাবিতে বহু মানুষ পথে নেমেছেন। সরকার এবং শাসক-বিরোধী স্লোগান উঠেছে সেই ‘অরাজনৈতিক’ জমায়েত থেকে। কিন্তু সেই স্লোগান যতই জোরদার হোক, তার সমান্তরালে পাল্লা দিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন তৃণমূলের কিছু নেতা।
অনেকের মতে, আরজি করের ঘটনার বিরুদ্ধে একটি ‘স্বাভাবিক ক্ষোভ’ পুঞ্জীভূত হয়েছে সমাজের সর্ব স্তরে। কিন্তু ডাক্তারদের বিরুদ্ধেও সাধারণ মানুষের একাংশের ক্ষোভ কম নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হাসপাতালে পরিষেবা না পাওয়া, ভুল চিকিৎসা, দুর্ব্যবহার কিংবা অবহেলায় রোগীমৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে চিকিৎসার অত্যধিক খরচ, ডাক্তারদের ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসার খরচ, দামি ওষুধ দেওয়া প্রভৃতি নানা কারণে নিম্ন এবং মধ্যবিত্তদের একটি বড় অংশ ক্ষুব্ধ। সেই ক্ষোভকে ‘পাল্টা হাতিয়ার’ করেছে তৃণমূল। কুণালের মতো নেতারা এই ক্ষোভকে বার বার উস্কে দিচ্ছেন। বলছেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালে ধর্মঘট, কর্মবিরতি করে বেসরকারি হাসপাতালে চুটিয়ে কাজ করা— এটা কোন ধরনের বিপ্লব?’’
তবে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব কিন্তু নীরবই থেকেছেন। বস্তুত, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ওই আন্দোলনের বিষয়ে যে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছেন, তাতে তাঁকে আন্দোলনকারীদের পক্ষের বলেই মনে হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এটিই ‘কৌশল’। প্রশাসনের প্রধান হিসাবে মমতা (এবং দলের অন্যতম শীর্ষনেতা হিসেবে অভিষেক) ডাক্তারদের প্রসঙ্গে এখনও ‘অনুরোধের’ উপরে ওঠেননি। ডাক্তারদের কর্মবিরতি তুলে নিতে বলে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, এর পর রাজ্য সরকার কোনও পদক্ষেপ করলে শীর্ষ আদালত হস্তক্ষেপ করবে না। তার পরেও নবান্ন কোনও ‘দমনমূলক’ নির্দেশ দেয়নি। কিন্তু দলের নেতা-কর্মীদেরও ‘শাসন’ করেননি মমতা।
মমতা ‘গুড কপ’। কুণালেরা ‘ব্যাড কপ’। মমতা নরমে। কুণালেরা গরমে। স্নায়ুযুদ্ধের কৌশল।