ফাইল চিত্র।
‘কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না’, ‘নানা খাতে প্রাপ্য অর্থ আটকে রাখছে’ ইত্যাদি অভিযোগ মাঝেমধ্যেই করে থাকেন রাজ্যের নানা স্তরের মন্ত্রী, শাসক দলের ছোটবড় নেতা থেকে খোদ মুখ্যমন্ত্রীও। কেন্দ্র টাকা না-দিয়ে লাগাতার বঞ্চনা করতে থাকায় রাজ্যে প্রয়োজনীয় কাজ করা যাচ্ছে না বলে তাঁদের অভিযোগ। কিন্তু নিজেদেরই স্বাস্থ্য দফতরের মুখে ঠিক বিপরীত কথা শুনে বেজায় অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। স্বাস্থ্য দফতর কবুল করেছে, সদ্য শেষ হওয়া আর্থিক বছরে এনএইচএম বা জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের প্রায় ৪০০ কোটি টাকা খরচই করতে পারেনি রাজ্য সরকার।
১১ জুন, শনিবার এ ব্যাপারে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের এনএইচএম-কর্তাদের ভিডিয়ো সম্মেলন হয়। তার পরে সে-দিনেই রাজ্যের সব জেলার সিএমওএইচ বা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকদের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ পাঠান সদ্য দায়িত্ব পাওয়া মিশন ডিরেক্টর (এনএইচএম) শুভাঞ্জন দাস। স্বাস্থ্য শিবির সূত্রের খবর, ওই বার্তায় তিনি জানান, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে কেন্দ্রের দেওয়া টাকার মাত্র ৬৮ শতাংশ খরচ দেখানো গিয়েছে। কিন্তু অন্তত ৭৫ শতাংশ অর্থ খরচ না-করলে নতুন অর্থবর্ষের প্রথম ভাগে কোনও টাকা দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র। বিগত অর্থবর্ষে রাজ্য সরকার প্রায় ৪০০ কোটি টাকা খরচ দেখাতে পারেনি। এক সপ্তাহের মধ্যে অন্তত ৭৫ শতাংশ খরচের হিসেব পাঠানোর জন্য সব জেলাকে নির্দেশ দেন শুভাঞ্জনবাবু।
এই বার্তায় জেলার স্বাস্থ্যকর্তাদের অনেকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। প্রশ্ন উঠছে, যে-অর্থ সারা বছরে খরচ হয়নি, তা এক সপ্তাহে খরচ করা যাবে কী ভাবে? কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, অর্থবর্ষ শেষ হয়েছে ২০২২-এর ৩১ মার্চ। তা হলে এখন এই জুনে খরচ দেখিয়ে কী করে নতুন অর্থবর্ষের টাকা পাওয়া যাবে?
তার থেকেও সর্বস্তরে যে-প্রশ্নটি সব চেয়ে বড় হয়ে উঠছে, তা হল, রাজ্য সরকার তো স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করছে। তা হলে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কেন্দ্রের দেওয়া এত টাকা পেয়েও খরচ করা গেল না কেন?
শুভাঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘টাকা খরচ হয়নি, তা নয়। কিন্তু কত খরচ হয়েছে, সেটা জেলাগুলি সময়মতো কেন্দ্রের ‘পাবলিক ফিন্যান্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’-এর পোর্টালে তোলেনি। বিভিন্ন কাজের দরুন তা তুলতে দেরি হয়েছে। সোমবার সব জেলার অ্যাকাউন্ট ম্যানেজারদের সঙ্গে বৈঠক হবে। তার পরে এক সপ্তাহের মধ্যে পোর্টালে খরচের হিসেব তোলা হবে।’’
২০২১-২২ অর্থবর্ষে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনে কেন্দ্রের কাছে প্রায় ৩৩০১ কোটি টাকার ‘প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন প্ল্যান’ জমা দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। তার মধ্যে কেন্দ্র অনুমোদন করেছিল ২৭৩৮ কোটি টাকার পরিকল্পনা। এই টাকার ৬০ শতাংশ কেন্দ্রের এবং ৪০ শতাংশ রাজ্যের দেওয়ার কথা। কেন্দ্র দিয়েছিল ১৬৪৩ কোটি টাকা এবং ১০৯৫ কোটি টাকা দিয়েছে রাজ্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের দেওয়া টাকার মধ্যে প্রায় ৪০০ কোটি খরচের হিসেব দিতে পারেনি রাজ্য সরকার। ফলে নিয়ম অনুযায়ী নতুন অর্থবর্ষে কেন্দ্রের অনুমোদিত টাকা থেকে সেই ৪০০ কোটি বাদ চলে যাওয়ার কথা। সেটা আটকাতেই রাজ্য এখন মরিয়া।
‘‘কেন্দ্র এখনও কোনও রাজ্যকেই এখনও নতুন বছরের টাকা দেয়নি। কিন্তু আমাদের প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন প্ল্যান অনুমোদন হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্র টাকা ছেড়ে দেওয়া মাত্রআমাদের তরফে তা পেতে যাতে কোনও সমস্যা না-হয়, তার জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে,’’ বলেন শুভাঞ্জনবাবু।
যদিও রাজ্যের একাধিক জেলার স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, সময়মতো কাজ না-করে এখন এই তাড়াহুড়োটা একটা অবাস্তব চেষ্টা। এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, ‘‘আশাকর্মীদের ইনসেন্টিভ দিতে দেরি হয়েছে। গর্ভবতী মায়েদের টাকা বাকি পড়েছে। আয়ুষ চিকিৎসকদের বেতন বাড়ানোর কথা বার বার বলা হলেও রাজ্য তা করেনি। প্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ কেনা হয়নি, অনেক বৈঠক হয়নি। টাকা খরচ হবে কী করে?’’
একটি জেলার সিএমওএইচ জানাচ্ছেন, স্বাস্থ্য দফতর যে-ব্যাঙ্কের মাধ্যমে কাজ করে, তাদের সার্ভার গোটা মার্চ-এপ্রিল ডাউন ছিল। ফলে কাজ হয়তো হয়েছে, কিন্তু তার টাকা দেওয়া হয়নি। অনেক ভেন্ডার আবার জিনিস দিয়ে সময়মতো বিল পাঠাননি। আবার অনেকে হয়তো বিল ঠিকমতো দিয়েছেন, কিন্তু জেলা যথাসময়ে সেই বিল স্ক্রুটিনি বা যাচাই করেনি। ফলে এখনও টাকা দেওয়া হয়নি। সব মিলিয়ে টাকা খরচ করতে চাপে পড়ে গিয়েছে রাজ্য সরকার।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।