যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন দফতরে যেতে চায় রাজ্য বিজেপি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ছোট্ট দফতর থেকে আর পারা যাচ্ছে না। বাংলার দায়িত্ব পেয়েই বলেছিলেন রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। তার পরেই হেস্টিংসে নতুন দফতর ভাড়ায় নিয়েছিল বিজেপি। কৈলাস জমানা শেষ। বাংলার দায়িত্বছাড়া হওয়াই শুধু নয়, গেরুয়া রাজনীতিতেই অনেকটা পিছনের সারিতে চলে গিয়েছেন বাংলায় বিজয় আনতে না পারা বিজয়বর্গীয়। রাজ্য বিজেপিতে এখন সুনীল বনশল জমানা। আর সেই জমানায় দলের নতুন ঠিকানা হতে চলেছে সল্টলেক। আইটি পাড়া সেক্টর ফাইভে চলে যাচ্ছে বিজেপির কর্পোরেট দফতর। রাজ্য দফতরের ঠিকানা হিসাবে অবশ্য থেকে যাবে ৬ নম্বর মুরলীধর সেনে লেনের আদিভূমিই।
বাংলার দায়িত্ব পেয়ে শুধু বড় অফিস নেওয়াই নয়, নিজেরও একটা স্থায়ী ঠিকানা তৈরি করেছিলেন কৈলাস। কিন্তু সে পথে হাঁটতে চান না সুনীল। সম্প্রতি বাংলা সফরের সময় তাঁকে ‘কোথায় ফ্ল্যাট নেবেন’ প্রশ্ন করলে বলেছিলেন, ‘‘আগে দলের একটা বড় দফতর হোক। তার পরে নিজের কথা ভাবা যাবে। আর আমি তো থাকতে আসিনি, বাংলা ঘুরে বেড়াতে এসেছি।’’ শুধু সুনীল নন, তাঁর সহকারী মঙ্গল পাণ্ডে, আশা লাকড়াও এখনও কোনও বাসস্থান ঠিক করেননি। বসার জন্য কোনও অফিসঘরও নেই। তবে সল্টলেকে নতুন অফিস হলে সেখানে সকলের জন্যই আলাদা আলাদা ঘর হবে।
মুরলীধর সেন লেনের বিজেপি অফিসে গেলেই এখন বোঝা যাচ্ছে, ঠিকানা বদলের তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। সরতে তো হবেই। রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার যে ঘরে বসেন, সেখানে জনা পাঁচেকের বেশি লোক ঢুকলে দরজা বন্ধ করে বৈঠক করা মুশকিল। সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের ঘরটায় এতটাই ড্যাম্প ধরে গিয়েছে যে, ভ্যাপসা-কটু গন্ধ থেকে বাঁচতে এই শীতেও এসি না চালালে নয়। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য এই অফিসে বড় একটা আসেন না। তবে তাঁর ঘর রয়েছে। সেটি ব্যবহার করেন সাধারণ সম্পাদকদের কেউ কেউ। এ ছাড়াও যুব মোর্চা বা মহিলা মোর্চার ঘরকে কুঠুরি বলাই ভাল। দেখে বোঝা দায়, বিজেপি এখন রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল।
গত বিধানসভায় হেস্টিংসে হয়েছিল বিজেপির ওয়ার রুম। নিজস্ব চিত্র
এই রকম পরিস্থিতির জন্যই বিধানসভা নির্বাচনের আগে, হেস্টিংসের কাছে ২ নম্বর সেন্ট জর্জেস গেট রোডের দশ তলা বাড়ির বেশ কয়েকটি তলা ভাড়া নিয়ে রাজ্য বিজেপির ওয়ার রুম তৈরি হয়েছিল। ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা ‘আগরওয়াল হাউস’-এর ওই দফতরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তবে তার বছর দেড়েক আগেই কৈলাসের উদ্যোগে ভাড়া নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। তৎকালীন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, কেন্দ্রীয় নেতা মুকুল রায়, শিব প্রকাশ, কৈলাস বিজয়বর্গীয়দের আলাদা দফতর হয়েছিল ন’তলায়। পরে শুভেন্দুরও ঘর হয়। কিছু দিনের জন্য ঘর ছিল রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। ঠিক নীচে অষ্টম তলের অর্ধেকটা জুড়ে রাজ্য বিজেপির অন্যান্য নেতার আলাদা আলাদা বসার ঘর ছিল। চতুর্থ তলের একটি অংশে ক্যান্টিন এবং পঞ্চম তলে সাংবাদিক সম্মেলনের জন্য হলঘর। এ ছাড়াও সপ্তম তলে ছিল ‘সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ’ কল সেন্টার।
এ সব এখন কৈলাস, শিবপ্রকাশ, মকুল, রাজীবের মতোই অতীত। একটি একটি করে তলার ভাড়া ছেড়ে দিয়েছে বিজেপি। পড়ে রয়েছে শুধু ন’তলা আর পাঁচ তলার হলঘরটি। সেটাও আর মাস দু’য়েক। রাজ্য বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, নতুন অর্থবর্ষের আগেই, মানে মার্চ মাসের মধ্যে ওই বাড়ি পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া হবে। সে পরিকল্পনা অনেক আগেই হয়ে যাওয়ায় এখনকার সভাপতি সুকান্তের জন্য ওখানে আর আলাদা করে ঘর বানানো হয়নি।
আদি দফতর থেকেই হবে পঞ্চায়েতের লড়াই। ঘর পেয়েছেন দেবশ্রী চৌধুরী। নিজস্ব চিত্র
নতুন দফতর প্রস্তুত করে ফেলার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে ফেব্রুয়ারির মধ্যে। রাজ্য বিজেপি এখনই বাড়িটির ঠিকানা বলতে না চাইলেও জানা গিয়েছে, এটি তৈরি হচ্ছে শিয়ালদহ-নিউটাউন মেট্রো লাইনের সেক্টর ফাইভ স্টেশনের কাছেই। উইপ্রো মোড়ের কাছে বাড়িটি পাঁচ তলা। বেশিটাই নতুন করে বানানো। হেস্টিংস থেকে একটু একটু করে যাবতীয় আসবাব চলে যাবে সেখানে। কিছু কিছু জিনিস যাবে মুরলীধর থেকেও।
তবে পুরোপুরি ব্রাত্য হয়ে যাবে না ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেনের রাজ্য দফতর। জানা গিয়েছে, আপাতত দলের ‘অফিসিয়াল’ ঠিকানা এটাই থাকবে। এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনা হবে এই বাড়ি থেকেই। এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য যে কমিটি রাজ্য বিজেপি বানিয়েছে তার প্রধান হয়েছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী। সম্প্রতি পুরনো অফিসেই নতুন ঘর পেয়েছেন দেবশ্রী। এর আগে তাঁর জন্য কোথাওই কোনও ঘর ছিল না।
পুরনো বাড়ি একেবারে ছেড়ে না দেওয়ার পিছনে অন্য কারণও রয়েছে। এটিও ভাড়ায় নেওয়া বাড়ি। দলের পুরনো নেতারা বলেন, বিজেপির আদিপুরুষ তথা জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও এক সময় এই দফতরে বসেছেন। ফলে সেটি ছাড়া চলবে না। তাঁদের আরও যুক্তি, ওই ছোট দফতর থেকেই বিজেপি এত বড় হয়েছে। এখন ‘সুখের দিনে’ পুরনোকে ভুললে চলবে কেন!
একটা দুঃখ ছিল রাজ্য বিজেপির। এখনকার কেন্দ্রীয় নেতারা কেউই এই দফতরে আসেননি। সম্প্রতি সেই আক্ষেপ কিছুটা হলেও মিটিয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কলকাতায় সরকারি সফরে এলেও ঘণ্টা দু’য়েকের জন্য গিয়েছিলেন রাজ্য বিজেপির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই বাড়িতে। তবে শাহরা আর ভাড়ার বাড়ি চান না। নড্ডারও ইচ্ছা বড় মাপের নিজস্ব বাড়িতে দফতর হোক রাজ্য বিজেপির। দল বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের অনেক রাজ্যেই সেটা হয়ে গিয়েছে। বাংলাতেও সেই উদ্যোগ চলছে। জমি খোঁজার পর্ব অনেকটা এগিয়েও গিয়েছে। কিন্তু জমি-জট কাটিয়ে সেখানে দফতর বানাতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। দলের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে অত অপেক্ষার উপায় নেই। তাই আপাতত আবার নতুন ভাড়ার বাড়ি।
ভাড়ার বাড়িই যদি নেওয়া হবে তবে হেস্টিংস থাকলেই তো হত? এই প্রশ্নের জবাবে রাজ্য বিজেপির এক নেতা বলেন, ‘‘ওই বাড়িটা আমাদের জন্য ঠিক পয়া নয়। গত লোকসভা নির্বাচনের মাঝামাঝি সময়ে ওটা ভাড়া নেওয়া হয়। প্রথম দিকের পর্বে যেখানে যেখানে ভোট হয়েছিল সেখানে আমরা ভাল ফল করেছিলাম। কিন্তু ওই বাড়ি থেকে যে যে দফার ভোট হয় তাতে দল মুখ থুবড়ে পড়ে। আর বিধানসভা নির্বাচনের স্বপ্নভঙ্গের কথা তো নতুন করে বলার নয়। গোটাটাই হেস্টিংসের অবদান।’’ এই দাবিকে সবাই গুরুত্ব দিচ্ছে না ঠিকই, তবে এটা চূড়ান্ত যে সুনীলযুগের রাজ্য বিজেপি চলল, সল্টলেকে চলল।