বীরভূমের প্রস্তাবিত কয়লাখনি ডেউচা পাঁচামি। নিজস্ব চিত্র।
সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এগারো বছরে একাধিক বাণিজ্য সম্মেলন (যার পোশাকি নাম বিশ্ব বঙ্গ শিল্প সম্মেলন বা বিজিবিএস) করেছে তাঁর সরকার। ঘোষণাও হয়েছে অনেক কিছু। কিন্তু বীরভূমের প্রস্তাবিত কয়লাখনি ডেউচা পাঁচামির মতো দু’-একটি ক্ষেত্র ছাড়া এখন সরকারের হাতে বড় কোনও শিল্প নেই। ছোট ও মাঝারি শিল্পের অবস্থাও খুব আশাপ্রদ নয়। শিল্প ক্ষেত্রে জড়িতদের একটা বড় অংশের ধারণা, বাণিজ্যমহলের মন থেকে এখনও সব ধন্দ দূর হয়নি।
শিল্প সংক্রান্ত সরকারি পর্ষদের বৈঠকে সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ বার পাঁচ রাজ্যে বিজিবিএস-এর আগাম প্রচার চালাবে সরকার। রাজ্যের ভাবমূর্তির সে ইতিবাচক প্রচারে সামনের সারিতে আসতেই পারে ডেউচা-পাঁচামি। সেখানে বিরোধী স্বর থাকলেও, প্রথম ধাপে যে অংশে কাজ শুরু হওয়ার কথা, সরকার ঘোষিত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন প্যাকেজে রাজি হয়ে সেখানকার প্রায় সকলেই জমি বিক্রি করেছেন জেলা পরিষদকে। ইচ্ছুক জমিদাতাদের পরিবারের প্রায় ১৩০০ জন সরকারি চাকরি পেয়েছেন। পরের ধাপের জন্য জমি কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বীরভূমে পাথর শিল্পাঞ্চলের অচলাবস্থা কাটাতে প্রয়োজন ছিল নতুন নীতি প্রণয়নের। সম্প্রতি সিদ্ধান্ত হয়েছে, এ বার থেকে শুধু সরকারি জমি নয়, পাথর উত্তোলনে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিও লিজ়ের আওতায় আনা যাবে।
পশ্চিম বর্ধমানে গত এক বছরে ১৪৩১ কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব এসেছে। এর আগে, দু’টি অর্থবর্ষে ৬৭৫ কোটি টাকা বিনিয়োগে ১১৪২টি অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রকল্প চালু হয়েছে। তাতে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে বলে সরকারি দাবি। অন্ডাল বিমাননগরীতে ৪৫০ একর এলাকায় শিল্পতালুক তৈরি হয়েছে। যদিও নানা বণিক সংগঠনের কর্তারা শিল্প নিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন বৈঠকে বার বারই দাবি করছেন, রাস্তা, বিদ্যুৎ-সহ প্রয়োজনীয় নানা পরিকাঠামোর উন্নতি না করলে, শিল্পের উপযুক্ত পরিবেশ মিলবে না।
পূর্ব মেদিনীপুরের তাজপুরে সমুদ্র বন্দর তৈরির ভার আদানি শিল্পগোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে আদানি-গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবস্থা এবং তৃণমূলের আদানি-বিরোধী প্রচারের প্রেক্ষিতে তাজপুর ফের কিছুটা হতাশায় ডুবেছে। একই ভাবে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে বাম জমানায় অধিগ্রহণ করা কমবেশি ৪ হাজার একর জমির কিছু অংশে আগে শিল্প হয়েছে। কিন্তু কিছু জমি ফেরত দিয়েছে বালাজি, আধুনিক, ইমামি, ডিসেরগড় পাওয়ার সাপ্লাই। বর্তমানে জঙ্গলসুন্দরী কর্মনগরীতে সাড়ে ৩ হাজার একরের মতো জমি রয়েছে শিল্পোন্নয়ন নিগমের হাতে। পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার জন্য বাম আমলে ৫৮৭ একর জমি কিনে দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। রাজ্য প্রশাসন সূত্রের দাবি, কয়েক মাস আগে নবান্নে বৈঠক করে এনটিপিসি কর্তারা জমি ফেরত দিতে চেয়েছেন। একই ভাবে যদিও সরকারের দাবি: পর্যটন, মাঝারি-ক্ষুদ্র শিল্প, বস্ত্র, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, কৃষি, চা শিল্প মিলিয়ে আগামী পাঁচ বছরে উত্তরবঙ্গের আটটি জেলায় বিনিয়োগ দাঁড়াবে ১১,০২৬ কোটি টাকার। কিন্তু জমি হস্তান্তর, বিদ্যুৎ পরিষেবা নিয়ে শিল্পমহলে ক্ষোভ রয়েছে। এনজেপি ড্রাই পোর্টে সিন্ডিকেট-রাজ চলে বলেও অভিযোগ। রাজ্যের বহু জায়গাতেই কাটমানি চাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
শিল্পমহলের একাংশের মতে, সিন্ডিকেটরাজ, কাটমানির মতো সমস্যা রাজ্যের অন্যত্রও আছে। তা ছাড়া রয়েছে গ্রামাঞ্চলে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জট। এই রাজ্যে জমি ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত। ফলে প্রশাসনের সাহায্য ছাড়া এক লপ্তে অনেকটা জমি কেনা কঠিন। কারণ, জমির উপরে নির্ভরশীলের সংখ্যা সেখানে অনেক। দ্বিতীয় সমস্যা, যেখানে সরকারের হাতে জমি রয়েছে, সেখানে হয়তো পরিকাঠামো ভাল নয়। তাই ব্যবসায়ী সেখানে যেতে রাজি হচ্ছেন না।
সংশ্লিষ্টমহলের বক্তব্য, এর উল্টো পিঠে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। তার হালও সব ক্ষেত্রে ভাল বলা কঠিন। যেমন, সূত্রের দাবি, মেদিনীপুরের ফুল, পান, কাজুবাদাম ঘিরে শিল্প-প্রসারে উদ্যোগী হয়নি সরকার। তাঁত শিল্পে নদিয়ায় কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু বন্ধ হয়ে যাওয়া কল্যাণী স্পিনিং মিলের কয়েকশো একরে ‘টেক্সটাইল হাব’ চালু হয়নি। নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অব কমার্স, ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ট্রেডের যুগ্ম সম্পাদক তারক দাসের কথায়, “শিল্প-বাণিজ্য বৈঠকে নদিয়ার শিল্প সম্ভাবনার একাধিক ক্ষেত্র কেবল চিহ্নিতই হয়েছে।’’ পূর্ব বর্ধমানের ল্যাংচা হাবের অবস্থাও ভাল নয়। আরামবাগের ঘড়া শিল্প বিলুপ্তির পথে।
ফলে আপাতত ছোট-বড় মিলিয়ে আশা একে ঠেকেছে ডেউচা পাঁচামি খনিতে। সঙ্গে যোগ করা যায়, অশোকনগরে ওএনজিসির তেল-গ্যাস প্রকল্পে রাজ্য সহযোগিতা করছে। গত বছর বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে মুর্শিদাবাদের রেজিনগর শিল্পতালুকে ই-বাস কারখানা করবে বলে এক সংস্থা চুক্তি করেছিল। কাজ এগোয়নি। মুর্শিদাবাদের এক বণিকসভার সাধারণ সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘‘প্রশাসনের তরফে শিল্পের জন্য ব্যবস্থার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে সহযোগিতা মিলছে না।’’
অর্থাৎ, কাপ আর ঠোঁটের ফারাক রয়েই যাচ্ছে।
(চলবে)