১৮৭২ সালের ১৩ নভেম্বর। ঘুম ভাঙছে উত্তর ফ্রান্সের বন্দর শহর লা আভরের। গা ছুঁয়ে বয়ে চলেছে স্যেন নদী। বন্দরের কাজকর্ম শুরু হবে, ইতিউতি জাহাজের ভোঁ। নদী তীরবর্তী হোটেলের জানালায় তখন দাঁড়িয়ে এক যুবক শিল্পী। চোখ পড়ল আকাশের দিকে। সূর্যোদয় হচ্ছে, আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে সোনালি, কমলা, লাল রং। জাহাজ আর ডিঙিনৌকার ছায়া ফুটে উঠছে নদীর জলে। রোমাঞ্চিত হলেন শিল্পী। ক্যানভাস সঙ্গেই ছিল। তুলিতে তেলরঙের পোঁচ পড়তে লাগল দ্রুতলয়ে। সময় কম, দৃশ্যপট দ্রুত বদলাচ্ছে। মুহূর্তটিকে ধরে রাখতেই হবে, ধরে ধরে রং লাগানোর সময় নেই। শিল্পী ক্লদ মোনে বুঝতেও পারেননি, তাঁর ক্যানভাসে জন্ম নিচ্ছে শিল্পের নতুন এক ধারা, আজ যাকে সারা বিশ্ব জানে ‘ইমপ্রেশনিজ়ম’ নামে।
মোনে ছবিটির নাম রেখেছিলেন ‘ইমপ্রেশন: সানরাইজ়’ (ছবি)। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, এ হল সূর্যোদয়ের প্রতিচ্ছায়া, যা তিনি এঁকেছেন রঙের ইমপ্রেশনে। রিয়্যালিস্টিক চিত্রধারা অনুযায়ী প্রকৃতির প্রতিটি অবয়ব, অনুষঙ্গ ও সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের রঙের পরিবর্তনের সরাসরি ধারাভাষ্য তিনি করতে চাননি, বন্দর-লগ্ন নদীর বুকে সূর্যোদয়ের প্রতিচ্ছায়া দেখার রোমাঞ্চকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন ক্যানভাসে। সেই রোমাঞ্চকর অনুভূতি বিশ্বের শিল্পমহল নাড়িয়ে দেয়, বদলে দেয় শিল্পের ইতিহাস। যা চোখে দেখা যায় তার পুঙ্খানুপুঙ্খ সবিস্তার বর্ণনাকেই চিত্রকলার মানদণ্ড মনে করা হত তার আগে পর্যন্ত।
চিত্রশিল্পের ইতিহাসে এই ছবিটিকে আজ উল্লেখ করা হয় এমন একটি কাজ হিসাবে, যা ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। যদিও এই ছবি আঁকার সময় মোনে ছিলেন সেই সব শিল্পীর অন্যতম, যাঁরা ইতিমধ্যেই সেই নতুন শৈলীতে কাজ শুরু করেছেন। প্যারিস ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলন গড়ে ওঠার পিছনে বিশেষ কারণ— এই সব অঞ্চলের নিসর্গ আর সারা দিন ধরে ক্রমাগত বদলে বদলে যাওয়া আলোর অনন্য চরিত্র। মোনে ছাড়াও পিয়ের-অগুস্ত রেনোয়া, আলফ্রেড সিসলি-সহ বেশ কিছু শিল্পী প্যারিস থেকে কাছে দূরে নানা জায়গায় ছুটে যেতেন প্রকৃতির অমোঘ সৌন্দর্যের টানে। সৃষ্টি করতেন এক-একটি ‘মাস্টারপিস’। সে সময়ে প্যারিসে রেলগাড়ির যাত্রা শুরু, পোর্টেবল ইজেল এবং রঙের টিউবের উদ্ভাবন শিল্পীদের যে এ ধরনের ছবি আঁকায় বহুলাংশে সাহায্য করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
জন্মলগ্নের শুরু থেকেই ইমপ্রেশনিজ়মকে নানা ভাবে কটাক্ষ ও হেয় জ্ঞান করা হয়েছে। ১৮৭৪ সালের ১৫ এপ্রিল এই ধারার ছবি নিয়ে প্রথম প্রদর্শনী হয় বিখ্যাত ফরাসি আলোকচিত্রকর, সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক ফেলিক্স নাদারের স্টুডিয়োতে। নানা রকম গ্র্যান্ড কাফে, কফি শপ ইত্যাদি দিয়ে ঘেরা এই স্টুডিয়োতে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল, যাতে অর্থবান শিল্পরসিক এবং ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। প্রদর্শনীটির নাম দেওয়া হয় ‘প্রিমিয়ার এক্সপোজ়িশন ১৮৭৪’। ক্লদ মোনে ছাড়াও বের্থ মরিস, ক্যামিল পিসারো, পল সেজ়ান, এডুয়ার্ড মানে, আলফ্রেড সিসলি, পিয়ের-অগুস্ত রেনোয়া, এডগার দেগা-সহ আরও অনেক শিল্পী যোগ দিয়েছিলেন। প্রায় দু’শো ছবি এই প্রদর্শনীতে স্থান পায়।
নতুন ধারার এই ছবির প্রদর্শনী সে ভাবে ক্রেতা বা সমালোচক কারও মনেই গোড়ায় দাগ কাটেনি। শিল্পীদের খুব কাছের বন্ধুবান্ধব, হাতে গোনা ক্রেতা আর দু’-এক জন সমালোচক ছাড়া খুব বেশি সাধারণ মানুষ এই প্রদর্শনী দেখতেও আসেননি তেমন। শিল্প-সমালোচকেরা এই ছবি নিয়ে তীব্র কটাক্ষ করতে শুরু করেন, রীতিমতো নিন্দাও উগরে দেন অনেকে। এই প্রদর্শনী, বিশেষ করে ‘ইমপ্রেশন: সানরাইজ়’ দেখে তখনকার এক বিখ্যাত শিল্প-সমালোচক লুইস লেরয় এই শিল্পীদের ‘আর্টিস্ট’-এর বদলে ‘ইমপ্রেশনিস্ট’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ছবির ধরন নিয়েও যারপরনাই নেতিবাচক ও বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন তিনি। উপহাসের সুরে বলা সেই ‘ইমপ্রেশনিস্ট’ শব্দটিই যে এক দিন অমর হয়ে শিল্প ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবে, কে জানত।
সেই সময় ফ্রান্সের সবচেয়ে আলোচিত প্রদর্শনী ছিল প্যারিস সালঁ। ১৭৪৮ সাল থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত এটিকেই পশ্চিমি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বার্ষিক বা দ্বিবার্ষিক শিল্প-অনুষ্ঠান হিসাবে বিবেচনা করা হত। এই প্রদর্শনীতে জুরিদের প্রশংসা সেই সময়ে যে কোনও শিল্পীকে প্রতিষ্ঠা পেতে দারুণ সাহায্য করত। তবে রক্ষণশীল শিল্প-ঘরানার মধ্যে থেকে প্রধানত বাইবেল-আশ্রয়ী, পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক ঘটনা সম্বলিত ছবিকেই গুরুত্ব দেওয়া হত। আজ এ তথ্য জেনে তাজ্জব বনতে হয়, এই জুরি কমিটি সেই সময় ক্লদ মোনে, পল সেজ়ান, এডুয়ার্ড মানে, পিয়ের-অগুস্ত রেনোয়া, এডগার দেগা প্রমুখের কাজ বাতিল বলে গণ্য করেছিল। জুরি কমিটির রক্ষণশীল রুচি এবং ক্লান্তিকর পৃষ্ঠপোষকতায় হতাশ হয়ে শিল্পী এডগার দেগা তাদের একটি কড়া চিঠিও পাঠান। জুরিদের উদ্দেশে তিনি লিখেছিলেন, “আপনারা দয়া করে পুরনো ধ্যানধারণার এই মানসিকতা পরিবর্তন করুন এবং সঠিক ভাবে কর্তব্য পালন করুন।”
নানা জায়গায় প্রত্যাখ্যাত হতে হতে এই ধারার শিল্পীরা পরে একত্র হয়ে ‘সোসাইটি অ্যানোনিমাস’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করেন। ত্রিশেরও বেশি শিল্পী মিলে সংস্থাটি তৈরি হয়, এরাই প্রথম ‘প্রিমিয়ার এক্সপোজ়িশন ১৮৭৪’ প্রদর্শনীটি আয়োজন করে।
এক নতুন শিল্পধারাকে তুলে ধরেছিল যে প্রদর্শনী, তারও দেড়শো বছর অতিক্রান্ত। শিল্পধারা সতত পরিবর্তনশীল। ক্লাসিসিজ়ম, নিয়োক্লাসিসিজ়ম’এর সময় পেরিয়ে ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলন, তার পর পোস্ট-ইমপ্রেশনিজ়ম। তারও পরে সময়ের দাবি মেনে বিশ শতকের গোড়া থেকে একে একে কিউবিজ়ম, ফভিজ়ম, এক্সপ্রেশনিজ়ম, সুরিয়ালিজ়ম, পপ আর্ট, অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজ়ম ইত্যাদি। একুশ শতকের শিল্পকথা-আলোচনায় এই সব আন্দোলনের ভূমিকাই অনস্বীকার্য, এই শিল্প আন্দোলন ও তা থেকে উঠে আসা সৃষ্টিগুলি সেই সময় ও শিল্পীর ভাবনারই চিহ্নবহ।