দমনাত্মক: মাওবাদী অধ্যুষিত জঙ্গল অঞ্চলে সিআরপিএফ জওয়ানরা, গিরিডি জেলা, ২০ নভেম্বর। ছবি: পিটিআই।
আর কিছু দিনের অপেক্ষা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বজ্রনির্ঘোষ, যে বছরটি গতপ্রায়, সেই বছর জুড়ে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার বড় রকমের সাফল্য পেয়েছে। নিজের একাধিক বার করা দাবিটিই ছত্তীসগঢ়ে সফরে গিয়ে পুনর্বার বলেছেন জোর গলায়: ২০২৬-এর মার্চের মধ্যে দেশ থেকে মাওবাদীদের নির্মূল করে দেওয়া হবে। দাবিটির বিষয়ে যে সত্যিই সরকার ‘সিরিয়াস’, তার হাতেগরম প্রমাণও মিলছে। মাওবাদী প্রভাবিত বিভিন্ন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে একের পর এক নিকেশ হয়ে চলেছেন মাওবাদীরা। মাত্র কিছু দিন আগেই ছত্তীসগঢ়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ‘সংঘর্ষ’-এ ৩১ জনের মৃত্যু হল।
এই বিপুল ‘সাফল্য’ বড় একটা আসে না। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মহল খুশি। প্রথমত, এত জনকে এক সঙ্গে সাবাড় করে দিতে পারলে দেশ জুড়ে সন্ত্রাসবাদীদের কাছে কড়া বার্তা যায়। দ্বিতীয়ত, পুলিশ-প্রশাসনের দাবি অনুযায়ী, বস্তারের অবুঝমাড়ের জঙ্গলে মাওবাদীদের দলে উচ্চপর্যায়ের এমন কয়েক জন ছিলেন, যাঁদের মাথার দাম সম্মিলিত ভাবে এক কোটি ৩০ লক্ষ টাকারও বেশি। তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষস্তরের বার্তা পাওয়ার পরে নিরাপত্তা বাহিনীর বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে মাওবাদীদের কী ভাবে শেষ করতে হবে।
তবু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে: এই কি একমাত্র পন্থা? মাওবাদীদের মত ও পথ নিয়ে বহু প্রশ্ন আছে, থাকবেও। কিন্তু এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবে না দেখে স্রেফ আইনশৃঙ্খলার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলেই কি সমস্যার সমাধান সম্ভব? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মতোই ইউপিএ সরকারের আমলে সেই একই স্বপ্ন দেখতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম। মনে করতেন, মাওবাদ দেশ থেকে মুছে যাওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। ২০১০-এর এপ্রিলে লালগড়ে গিয়ে চিদম্বরম জানিয়ে দিয়েছিলেন, ২০১৩-র মধ্যে দেশ থেকে মাওবাদী আন্দোলন নির্মূল হয়ে যাবে।
হয়নি। চিদম্বরমের ওই সদর্প ঘোষণার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই মাওবাদীদের আক্রমণে প্রাণ যায় সিআরপিএফের ৭৬ জন জওয়ানের। ঘটনাস্থল ছত্তীসগঢ়ের দন্তেওয়াড়া জেলার চিন্তলনাড়। এর আগে নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে মাওবাদীদের এত ভয়ঙ্কর আক্রমণের সাক্ষী থাকেনি দেশ। কংগ্রেস নেতৃত্ব এখন দলিত ও জনজাতিদের অধিকার রক্ষা নিয়ে নানা কথা বলেন। কিন্তু তাঁরা ভুলেও বলেন না যে তাঁদের আমলেই শুরু হয় ‘সালওয়া জুড়ুম’ অভিযান। মূলত জঙ্গল ও পাহাড়ে ঘেরা বস্তারের গ্রামাঞ্চলে মাওবাদীদের প্রভাব কমাতে সেখান থেকে আদিবাসী পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের নিয়ে আসা হত ‘সালওয়া জুড়ুম’ ক্যাম্পে, মাওবাদীদের হাত থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার নামে। এই ‘সালওয়া জুড়ুম’কে কেন্দ্র করে দরিদ্র আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষের উপর ভয়াবহ নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, গ্রামের বাড়ি বাড়ি অগ্নিসংযোগের মতো মারাত্মক অভিযোগ উঠতে থাকে। মূলত যাঁকে সামনে রেখে এই ‘সালওয়া জুড়ুম’ আন্দোলনের সূত্রপাত, সেই কংগ্রেস নেতা তথা ছত্তীসগঢ় বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা মহেন্দ্র কর্মা ‘বস্তারের বাঘ’ বলে পরিচিত ছিলেন। কয়েক বছর পরে ছত্তীসগঢ় রাজ্য কংগ্রেসের কার্যত গোটা শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মহেন্দ্র কর্মাও মাওবাদীদের হামলায় নিহত হন।
পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড বা ওড়িশায় বনবাসী ও আদিবাসীদের উৎখাত করতে সরকার বার বার এত তৎপর হয় কেন? এর পিছনে রয়েছে খনিজ আকরিক উত্তোলনে বৃহৎ পুঁজির অবদান। রয়েছে তাকে ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন সমীকরণ। এবং এখানেই নিহিত আছে জনজাতি ও প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে অতি-বাম রাজনীতির আবর্তনের সূত্র।
কংগ্রেসের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক তথা মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিংহ বলেছিলেন, মাওবাদী বৃদ্ধির তিনটি কারণ হল, জনজাতি বিল কার্যকর না করা, নিম্নমানের প্রশাসন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আদিবাসীদের অধিকার না থাকা। তুচ্ছ বনজ সম্পদের উপরে তাঁদের অধিকার দিলেই শুধু চলবে না, প্রধান বনজ ও খনিজ সম্পদের অধিকারও দিতে হবে।
ইউপিএ সরকারের আমলে গঠিত এক বিশেষ কমিটির রিপোর্টের একটি ছোট্ট অংশের উল্লেখ করা যাক। সেই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন কেন্দ্রের প্রাক্তন ভূমিরাজস্ব সচিব দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী কে বালাগোপাল-ও। মূলত সন্ত্রাসবাদ প্রভাবিত এলাকার উন্নয়ন বিষয়ক কাজ করেছিল সেই কমিটি। সেই রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৬০ সালের নকশাল আন্দোলনকে বলপ্রয়োগ করে দমন করা হয়। তার পর থেকে একটি পুলিশ থানা এলাকা, একটি জেলা এবং একটি রাজ্যের আন্দোলন ৫৬০টি পুলিশ থানা, ১৬০টি জেলা এবং ১৪টি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এর অর্থ, জোর করে আন্দোলন না দমিয়ে এলাকার মানুষের জন্য প্রকৃত উন্নয়নের ব্যবস্থা করে, তাঁদের অভাব-অভিযোগ ও মনোভাব জেনে, তাঁদের যথাযথ পুনর্বাসন দিলে যে কাজ হতে পারে, শুধু দমন-পীড়নের নীতি নিলে তা সম্ভব নয়।
এর পর প্রশ্ন উঠবেই, হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলে, বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ চলতে থাকলে সরকার কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? একেবারেই নয়। শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সরকারকে ব্যবস্থা করতেই হবে। অতি-বাম রাজনীতি যাঁরা করেন, বিশেষত বন্দুকের নলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন যাঁরা এখনও দেখে চলেছেন, তাঁদেরও নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে, অধিকার রক্ষার লড়াই কি শুধুই হিংসার পথে চলবে?
কিন্তু, ক্ষমতায় আসার পর থেকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি নিয়ে চলছে, তা-ও কি সমর্থনযোগ্য? আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে মাওবাদী নির্মূল করার ঘোষণা কি শেষ অবধি আশ্বাস দেয় দারিদ্র-লাঞ্ছিত জনজাতি-অধ্যুষিত জনসমাজকে? নাগরিকদের স্বার্থরক্ষায় কোনও কল্যাণকামী রাষ্ট্র কঠোর পদক্ষেপ করতেই পারে, কিন্তু এখন যা চলছে, মাওবাদী দমনের নামে যে হারে নিধনযজ্ঞ চলছে, সেটাও কাম্য হতে পারে না। কারা প্রকৃত মাওবাদী আর কারা নিরীহ গ্রামবাসী, প্রতিটি ‘সংঘর্ষ’র ঘটনার পরে কি তা নিয়ে যথাযথ তদন্ত হয়? নিরীহ ও দরিদ্র গ্রামবাসীদের পাল্টা বক্তব্য কে-ই বা শুনতে চায়?
সরকার ইতিপূর্বে উত্তর-পূর্ব সমেত বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালিয়েছে, চুক্তিও হয়েছে। অথচ একটি অতি-বাম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হল না। উল্টে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারী মাওবাদী মুখপাত্র তথা অন্যতম শীর্ষ নেতা আজাদ ও তাঁর সঙ্গে থাকা সাংবাদিক হেমচন্দ্র পান্ডেকে সংঘর্ষের নামে হত্যা করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল, “আমাদের প্রজাতন্ত্র তার নিজের সন্তানদের খুন করতে পারে না।”
রাষ্ট্রশক্তির সগর্ব ঘোষণার সঙ্গে এই প্রশ্নটাও উঠুক যে, দেশের নাগরিকেরা কেন বার বার হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছেন? ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’-এর দেশে কেন বছরের পর বছর ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম চলবে? ২০২৬-এর মার্চের মধ্যে আরও কত জনকে ‘খতম’ করা যাবে? তার পর?