গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে শুক্রবার সকাল থেকেই সক্রিয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-র আধিকারিকরা। সকাল ৮টা নাগাদ ইডির তদন্তকারীরা রাজ্যের মন্ত্রী তথা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি-সহ মোট ১৩টি জায়গায় তল্লাশি অভিযান শুরু করেন। শুক্রবার এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার সময় পর্যন্ত সেই অভিযান চলেছে। রাজ্য জুড়ে ১৩টি জায়গায় একসঙ্গে ম্যারাথন তল্লাশিতে নেমেছেন ইডির ৮০ থেকে ৯০ জন তদন্তকারী।
ঘটনাচক্রে, এর ২৪ ঘণ্টা আগেই ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে ইডির গোয়েন্দাদের ‘সাদর আপ্যায়নের’ পরামর্শ দিয়েছিলেন রাজ্যের শাসকদলের নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্র যে ইডি-সিবিআইয়েরর মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাকে হাতিয়ার করে বিরোধী দলের নেতা-মন্ত্রীদের হেনস্থা করতে চাইছে, সে প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে মমতা বলেন, ‘‘সিবিআই এলে আসন পেতে দেবেন। বলবেন, আসুন আসুন বসুন। সিবিআই-ইডি বাড়িতে এলে থালায় করে মুড়ি খেতে দেবেন ওঁদের।’’
মমতা তাঁর নিজস্ব ভাষণশৈলীতেই বলেছিলেন কথাগুলি। তবে সেই ভাষণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ‘এসএসসি দুর্নীতি’র তদন্তে ইডির হঠাৎ ‘সক্রিয়’ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইতিমধ্যেই রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, ‘‘ইডির তৎপরতা আগে কখনও দেখিনি। রাজনৈতিক নেতাদের হেনস্থা করা বিজেপির হাতিয়ার। বাংলায় বিজেপির কিছু নেই। বাংলার বিজেপির শক্তি ইডি। গতকাল আমরা কেন্দ্রকে আক্রমণ করেছি। লড়াই শুরু হয়েছে। তাই প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে।’’
অন্য দিকে, ইডি-হানা প্রসঙ্গে তৃণমূলকে বিঁধে বিজেপি সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘‘আরও আগেই এই তল্লাশি হওয়া উচিত ছিল। হয়তো ইডির লোকবল ছিল না বলে আগে করতে পারেনি।’’
রাজ্যের ‘শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি’তে কয়ের হাজার কোটি টাকার আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে বরাবারই অভিযোগ করে এসেছেন মামলাকারীরা। সেই মামলার তদন্তভার কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআইকে দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। তবে যেহেতু মামলাটির সঙ্গে ‘আর্থিক দুর্নীতি’ জড়িয়ে আছে, সে জন্য কেন্দ্রীয় আর্থিক নিয়ামক সংস্থা (ইডি)-ও এর তদন্তে নামতে পারে বলে অনুমান করা হয়েছিল আগেই। অবশেষে শুক্রবার, ২২ জুলাই ‘এসএসসি দুর্নীতি’র আর্থিক বিষয়গুলি খতিয়ে দেখতে তদন্তে নামল তারা।
শুক্রবার সকাল ৮টা নাগাদ ইডির আধিকারিকরা পৌঁছে যান রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী তথা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপধ্যায়ের নাকতলার বাড়িতে। তার পর একে একে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেখলিগঞ্জের বাড়ি, এসএসসির উপদেষ্টা কমিটির প্রাক্তন আহ্বায়ক শান্তিপ্রসাদ সিংহ, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্য, পর্ষদের সচিব রত্না চক্রবর্তী বাগচীর বাড়িতেও ইডি-র তল্লাশি অভিযানের খবর আসতে থাকে।
উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের ‘শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি’ মামলায় ইডি এর আগে তদন্ত শুরু করেনি তা নয়। জুনের শেষ দিকে এক বার প্রাথমিকে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে ৬০ জন প্রাথমিক শিক্ষককে সিজিও কমপ্লেক্সে তলব করে ইডি। এই শিক্ষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, নিয়োগ হলেও তাঁদের নামে কোনও ওএমআর শিট পাওয়া যায়নি। তবে এই প্রথম রাজ্য জুড়ে এ ভাবে একসঙ্গে রাজ্যে ১৩ জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালালেন ইডি আধিকারিকরা।
সূত্রের খবর, ‘এসএসসি দুর্নীতি’ মামলায় মূলত ফৌজদারি বিষয়গুলির তদন্ত করছে সিবিআই। অর্থাৎ কী ভাবে দুর্নীতি হয়েছে, তা খুঁজে বার করবে তারা। ইডির তদন্তে উঠে আসতে পারে, ঠিক কত টাকার লেনদেন হয়েছে এই মামলায়। ওই বিপুল অর্থ কোথা থেকে এল? কার কার কাছে সেই অর্থ পৌঁছল? ঘটনায় প্রভাবশালী যোগের বিষয়গুলিও উঠে আসতে পারে ইডির তদন্তে।
শুক্রবার টানা প্রায় সাড়ে সাত-আট ঘণ্টা তল্লাশি অভিযানের পরও পার্থের বাড়ি থেকে বেরোননি ইডির আধিকারিকরা। অন্য দিকে, মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীকে বেআইনি ভাবে শিক্ষকতার চাকরি পাইয়ে দেওয়ায় অভিযুক্ত মন্ত্রী পরেশের মেখলিগঞ্জের বাড়িতেও যান ইডির কর্তারা। পরেশ নিজে যদিও ছিলেন কলকাতায়, তবে তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর বাড়ির লোকজনের থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে ইডি। এসএসসি দুর্নীতির অন্যতম অভিযুক্ত শান্তিপ্রসাদের বাড়িতেও এক মহিলা-সহ সাত জন ইডি আধিকারিক পৌঁছন। দুই মন্ত্রী এবং শান্তিপ্রসাদের বাড়ির ভিতরে যখন ইডির অভিযান চলছে, তখন বাইরে প্রহরায় ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। একই দৃশ্য দেখা যায় অন্যান্য অভিযুক্তের বাড়িতেও।