প্রতীকী চিত্র।
ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে মোট যত আসন, তার চেয়ে তৃণমূলের মনোনয়ন হাজার দশেক বেশি পড়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তরফে সেই তথ্য প্রকাশিত হতেই ‘গোঁজ কাঁটা’ নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছে শাসকদলের অন্দরে। তবে সর্বত্রই যে এমন পরিস্থিতি, তা নয়। তৃণমূল সূত্রে খবর, কোথাও কোথাও দলের ‘নির্দেশে’ই ‘গোঁজ’ পোঁতা হয়েছে! শুধু তা-ই নয়, নির্দল হিসাবে তাঁদের জিতিয়ে আনার ভাবনাও রয়েছে দলের। এমন কৌশলের পিছনে তিন অঙ্ক রয়েছে বলেই জানাচ্ছে শাসকদলের একাংশ।
দলীয় সূত্রে খবর, প্রাথমিক ভাবে গোঁজ প্রার্থী আটকাতে মনোনয়নে ‘ধীরে চলো’ নীতি নেওয়া হয়েছিল। প্রার্থিতালিকাও তৈরি হয়েছিল অতিসাবধানতা অবলম্বন করে। কিন্তু সেই কৌশলেও পুরোপুরি আটকানো গেল না গোঁজ কাঁটা। মনোনয়ন পর্ব মিটতেই গোঁজের হিসাব করতে দলের অন্দরে ব্যস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছে। বহু জায়গায় এই গোঁজ প্রার্থীদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন বিরোধী প্রার্থীরা। ভোট কাটাকাটিতে যদি কোনও ভাবে বৈতরণী পার করা যায়! দলীয় নির্দেশ অমান্য করে যাঁরা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশে ইতিমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের আশা, দলীয় নির্দেশ অমান্য করা গোঁজ প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেবেন। যদি তা সম্ভব হয়, তা হলে গোঁজ কাঁটায় আসলে বিরোধীরাই বিদ্ধ হতে চলেছে বলে দাবি শাসকদলের একাংশের।
সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামবাংলায় আবাস যোজনা, একশো দিনের কাজ, রাস্তাঘাট, জলের ব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে জমে থাকা বিস্তর ক্ষোভ প্রকাশ্যে এসেছে। ‘দিদির দূত’ কর্মসূচির সময় বহু জায়গায় সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অনেক জায়গায় শাসকদলের স্থানীয় নেতা-নেত্রীদের দেখা না পাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূল সূত্রে খবর, এই বিষয়গুলি নিয়ে দলের অন্দরে আশঙ্কা ছিলই। তা নজরে রেখেই বাড়তি মনোনয়নের কৌশলকে নতুন মোড়ক দেওয়া হয়েছে। বহু জায়গায় নির্দল প্রার্থী হিসাবে এমন কিছু ব্যক্তিকে ভোটে দাঁড় করানো হয়েছে, যাঁরা স্বচ্ছ ভাবমূর্তির এবং প্রকাশ্যে ‘অরাজনৈতিক’ হলেও আদতে ‘তৃণমূল মনোভাবাপন্ন’। তৃণমূলের এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘আবাস যোজনার ঘর, নানা সামাজিক প্রকল্পের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যা ভূমিকা ছিল, তা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। বহু ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য, বেনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এই পরিস্থিতিকে বিরোধীরা যাতে কাজে লাগাতে না পারে, তাই এই কৌশল।’’
কমিশনের তথ্য বলছে, রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের মোট আসন সংখ্যা ৭৩ হাজার ৮৮৭। এ দিকে তৃণমূলের মনোনয়ন জমা পড়েছে মোট ৮৪ হাজার ১০৭। তৃণমূল সূত্রের দাবি, কিছু আসনে যেমন দলের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে অনেকে মনোনয়ন দিয়েছেন, তেমনই অনেক জায়গায় কৌশলগত কারণেও একাধিক মনোনয়ন জমা পড়েছে। এর পর কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনের মধ্যে দলীয় নেতৃত্ব ‘ফর্ম-বি’র মাধ্যমে একটি আসনে এক জন প্রার্থীর প্রতীক চূড়ান্ত করবেন। বাকি যাঁরা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন, তাঁরা নির্দল প্রার্থী হিসাবে বিবেচিত হবেন। কিন্তু এই বাড়তি মনোনয়নের কৌশলের প্রয়োজন পড়ল কেন? তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ২০ জুন, মঙ্গলবার। দল ওই দিন পর্যন্ত দেখে নিতে চায়, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ এড়াতে ঠিক কাকে প্রার্থী করা যেতে পারে। প্রার্থিতালিকার নিরিখে যিনি দলের প্রার্থী, স্থানীয় ‘জনমত’ তাঁর বিরুদ্ধে হলে শেষ মুহূর্তে প্রার্থী বদলে ফেলতে কোনও অসুবিধা হবে না। এ ছাড়া গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও এড়ানো যায়। দলের আর এক রাজ্য নেতা বলেন, ‘‘অনেক সময় দেখা যায়, একটি আসনের দাবিদার দু’জন। প্রার্থিতালিকায় যাঁর নাম থাকল না, তিনি স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষুব্ধ হন। দুই যুযুধান পক্ষের মধ্যে এক জনকে বেছে নিলে দ্বন্দ্ব মেটার সম্ভাবনা থাকে না। চলতেই থাকে। পরিবর্তে যদি তৃতীয় কাউকে শেষ মুহূর্তে প্রার্থী করা যায়, তা হলে বিষয়টা অন্য রকম হয়!’’
তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, ভোটের ঘোষণার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন জায়গার জল মাপছিলেন দলীয় নেতৃত্ব। কোথায় কার বিরুদ্ধে কেমন ক্ষোভ, প্রার্থী বাছাইয়ের সময় সব কিছু নজরে রাখা হয়েছে। তার ভিত্তিতেই প্রার্থিতালিকা তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গেই কোন আসনে কোন গোঁজ প্রার্থী দাঁড়াবেন, সেই সিদ্ধান্তও হয়। তবে সব জেলাতেই যে গোঁজ প্রার্থী রেখে দেওয়া হয়েছে, তা নয়। যে সব জায়গায় এই কৌশল নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নদিয়া। সেই জেলার করিমপুর ১ ব্লকে তৃণমূলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি তরুণ সাহা বলছেন, ‘‘শেষ মুহূর্তে কোনও সমস্যা এড়াতে প্রতিবারই বাড়তি প্রার্থী দেওয়া হয়। তবে এ বার একটু বেশি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।’’ তৃণমূলের কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি কল্লোল খাঁও বলেন, ‘‘প্রার্থী নির্বাচনে কোনও ভুল হলে শেষ মুহূর্তেও তা যেন শোধরানো যায়, তাই এই কৌশল। তবে বহু ক্ষেত্রেই দলের অনুমোদন ছাড়া অনেকে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। তাঁদের দিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করানো অবশ্যই জরুরি। নয়তো কোনও কৌশলই কাজে আসবে না।’’