সিঙ্গুর রায় নিয়ে আইনি পথে হাঁটার ভাবনা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সিঙ্গুর নিয়ে টাটা গোষ্ঠীকে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে যে নির্দেশ দিয়েছে সালিশি আদালত (আর্বিট্রাল ট্রাইব্যুনাল), সেই নির্দেশকে কি চ্যালেঞ্জ করতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার? রাজ্য প্রশাসন সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে আইনি পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। রাজ্য প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ আমলা মঙ্গলবার আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ শুরু করেছেন। তবে এই নির্দেশের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে মামলা করা হবে, না কি সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া হবে, সে বিষয়েও আলোচনা চলছে বলে সূত্রের খবর।
প্রসঙ্গত, টাটা মোটরসকে ৭৫৬.৭৮ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বলে সোমবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিল্পোন্নয়ন নিগমকে নির্দেশ দিয়েছে সালিশি আদালত। সেই নির্দেশের প্রেক্ষিতে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে একটি বিবৃতি জারি করে টাটা গোষ্ঠী। সেখানে তারা জানিয়েছে, “২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর তিন সদস্যের সালিশি আদালতে সিঙ্গুরে অটোমোবাইল কারখানা মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। সর্বসম্মত ভাবে ট্রাইব্যুনাল, টাটা মোটরসকে ৭৬৫.৭৮ কোটি টাকা দিতে বলেছে। সেই সঙ্গে, ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে পুরো ক্ষতিপূরণ পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ১১ শতাংশ হারে সুদ দিতে বলা হয়েছে।”
আইন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সালিশি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করার রাস্তা সবসময়েই খোলা রয়েছে। কিন্তু আবেদন করতে গেলে রাজ্য সরকারকে মোট প্রদেয় অর্থের ৫০ শতাংশ জমা দিতে হবে। সেই অঙ্কটিও নেহাত কম নয়। দ্বিতীয়ত, সালিশি আদালতের রায় বিচারবিভাগীয় আদালত নাচক করে দিয়েছে, এমন সাধারণত হয় না। সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে করছেন আইনজ্ঞদের একাংশ। যদিও তা যে একেবারেই হবে না, তেমনটাও তাঁরা বলছেন না। তবে আইন বিশারদদের মতে, সিঙ্গুর একটি ‘জটিল’ মামলা। জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি নিয়ে জমিদাতা এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে টানাপড়েন চলছিল। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার জমি অধিগ্রহণ করেছিল। ফলে তারাই জমির একচ্ছত্র মালিক ছিল। তারা টাটাকে জমি বিক্রি করে। তার পরে রাজ্য সরকারই আবার জমি ফেরত চায়।
অনেকেই মনে রছেন, সোমবার সালিশি আদালত যে রায় দিয়েছে, তা সিপিএমের বিরুদ্ধে গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে নয়। তাঁদের মতে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার পুরো পরিস্থিতির মোকাবিলায় অপেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। যার ফল বামেদের রাজনৈতিক ভাবে ভুগতে হয়েছে।
২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে বিপুল জয় পাওয়ার পর হুগলির সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো গাড়ি কারখানা প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব। টাটাকে সে বাবদে ১০০০ একর জমি দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিঙ্গুরে গাড়ি প্রকল্প গড়তে পারেনি টাটা। গাড়ি প্রকল্প যখন ব্যর্থ হল, তখন মমতার সরকার টাটার কাছে জমি ফেরত চেয়ে পাঠায়। টাটা গোষ্ঠী জমি ফেরাতে সম্মত হয়। পাশাপাশি, জমি ফেরানো বাবদে খরচ দাবি করে রাজ্য সরকারের কাছে। জমির দামের সঙ্গেই সেই খরচের অন্তর্গত ছিল ওই জমির পিছনে টাটার বিনিয়োগ করা অর্থও। টাটার প্রস্তাবে রাজি হয়নি রাজ্য সরকার। তার পর সেই লড়াই পৌঁছয় আদালতে।
সোমবার সালিশি আদালতের নির্দেশের পর থেকে রাজ্য রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। ময়দানে নেমে প়ড়েছে সিপিএম এবং বিজেপি। পুজোর পর সোমবারেই নবান্ন খুলেছে। আর সেই দিনই সালিশি আদালতের এই নির্দেশ এসেছে রাজ্য সরকারের কাছে। নবান্ন সূত্রে খবর, সেই নির্দেশ পাওয়ার পরেই মুখ্যসচির হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী বিষয়টি দেখছেন। তবে যে বিপুল পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে, তা নিয়ে আপত্তিও জানানো হয়েছে।