সিঙ্গুরের কারখানার অবশেষ। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
সিঙ্গুরে আফগানিস্তান আছে। সিঙ্গুরে রশিদ খান আছেন। সিঙ্গুরে বালু মল্লিকও আছেন। কিন্তু টাটা নেই। নেই মানে একেবারেই নেই! সিঙ্গুর আছে। চায়ের দোকানে জটলা আছে। মঙ্গলবার সকালের আড্ডায় রাজা-উজির মারা আছে। আর আছে অতীত বিস্মৃত হওয়া।
মুম্বই স্টক এক্সচেঞ্জকে সোমবার টাটা গোষ্ঠী বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, সালিশি আদালত (আর্বিট্রাল ট্রাইব্যুনাল) নির্দেশ দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে তারা সিঙ্গুর বাবদে ক্ষতিপূরণ পাবে ৭৬৫.৭৮ কোটি টাকা। যত দিন না তা আদায় হচ্ছে, তত দিন ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১১ শতাংশ হারে রাজ্য সরকারকে সুদ দিতে হবে। পাশাপাশি দিতে হবে মামলার খরচ বাবদ ১ কোটি টাকা। সেই রায় নিয়ে সোম-সন্ধ্যা থেকেই রাজনীতি সরগরম। তৃণমূল, সিপিএম, বিজেপি তাল ঠোকাঠুকি শুরু করেছে। কিন্তু তা থেকে অনেক দূরে সিঙ্গুর। যে জনপদকে নিয়ে এত আলোচনা, সেখানে কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। অন্তত রায়ের পরের সকালে তেমনই চিত্র।
সিঙ্গুর স্টেশন লাগোয়া গোটা আষ্টেক চায়ের দোকানে মঙ্গলবার সকাল সকাল ঢুঁ মেরে বোঝা গেল,‘চায়ে পে চর্চা’য় অন্য বিষয় রয়েছে। রয়েছে ক্রিকেট বিশ্বকাপে আফগানদের দাপট, রয়েছে রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় (বালু) মল্লিকের হাসপাতাল থেকে ইডি হেফাজতে যাওয়া, রয়েছে বাকিবুর রহমানের ফুলেফেঁপে ওঠা। কিন্তু টাটা নেই।
স্টেশনঘেঁষা বুড়ো শান্তির মাঠ অনেক দিন আগেই ছোট ছোট দোকানের ‘মার্কেট কমপ্লেক্স’ হয়ে গিয়েছে। সেখানকার ৩ নম্বর স্টলটি ছিল তাপসী মালিকের বাবা মনোরঞ্জন মালিকের। ইমিটেশনের গয়না বিক্রি করতেন মনোরঞ্জন। মঙ্গলবার সকাল সওয়া ৭টা নাগাদ সেখানে গিয়ে দেখা গেল, শাটার বন্ধ। তাতে ঝুলছে একটি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে হয়ে যাওয়া রক্তদান শিবিরের ফ্লেক্স। শাটারে বেশ পুরু ঝুলের আস্তরণ। পাশেই টেবিল পেতে চা বিক্রি করছেন পক্বকেশ বৃদ্ধ রাজেন্দ্র সাউ। তিনি বললেন, ‘‘সাত-আট মাস হয়ে গেল দোকান বন্ধ। আগে তা-ও মাঝেমাঝে এসে দেখে যেত মনা। এখন তা-ও আসে না।’’ রাজেন্দ্রের দোকানে পাতা দু’টি বেঞ্চে ভরা লোক। সকাল সওয়া ৭টায় বাতাসে শীত শীত ভাব। অনেকের গলায় মাফলার। কিন্তু তাঁদের গলায় টাটা নেই। আলোচনায় রয়েছে পর পর কয়েক দিন ধরে ডাউন হরিপাল লোকালের লেট হওয়া নিয়ে বিরক্তি। আলোচনায় আছে শিমের ফলন ভাল হওয়া। কিন্তু টাটা? সালিশি আদালতের রায়? কোথাও নেই।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ফোনে পাওয়া গেল তাপসীর বাবা মনোরঞ্জনকে। জানালেন, পায়ের চোটের জন্য দোকান খুলতে পারেন না। কিন্তু সিঙ্গুরের আলোচনায় টাটা নেই কেন? তাপসীর বাবাও আধো আধো শুনেছেন, কী যেন একটা রায় বেরিয়েছে। কিন্তু ভাল করে জানেন না। কথা বলে বোঝা গেল জানতে চানও না। মনোরঞ্জন কথায় কথায় শুধু বললেন, ‘‘এত দিন হয়ে গেল। মেয়েটা বিচার পেল না!’’ মাঝে মনোরঞ্জন তৃণমূলের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। পাঁচ বছর আগের পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদে নির্দল প্রার্থীও হয়েছিলেন। তাঁর নির্বাচনী প্রতীক ছিল একটি ছোট গাড়ি। অনেকটা টাটা ন্যানোর মতো দেখতে। তার পর অবশ্য সেই ভুল বোঝাবুঝি মিটে গিয়েছে। এখনও তাঁর ভরসা দিদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই।
মহামায়া স্কুলের কাছে একটি চায়ের দোকান আরও জমজমাট। সকাল পৌনে ৮টায় সেখানকার আলোচনায় বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের ‘জায়ান্ট কিলার’ হয়ে ওঠা নিয়ে বিস্ময়। সেইসঙ্গে চায়ের ঠেকসুলভ বাজি ধরা, আফগানেরা এ বার অস্ট্রেলিয়াকেও হারিয়ে দেবে!
সাড়ে ৮টা নাগাদ সিঙ্গুর থানা লাগোয়া একটি চায়ের দোকানে টিফিন খাওয়ার ভিড়। থালা-ভরা মুড়ির উপর ডাবু হাতা দিয়ে গরম ঘুগনি ঢেলে দিচ্ছেন দোকানমালিক। চলছে অমলেট ভাজা। সেখানে গজল্লা বাকিবুরের দিঘার হোটেল, সিনেমা প্রযোজনার খবর নিয়ে।
সিঙ্গুরের বাসিন্দা রবীন মালিক কাজ করেন কলকাতার একটি বেসরকারি সংস্থায়। সকাল ৯টা নাগাদ তিনি কপালে কমলা টিকা কেটে (সম্ভবত মঙ্গলবারের বজরংবলীর পুজোর উপচার মেনে) এলেন স্টেশন লাগোয়া পৃথক একটি চায়ের দোকানে। মুড়ি-ঘুগনির সঙ্গে একটি ডিমসেদ্ধ অর্ডার দিয়ে দোকানমালিকের কাছে শুরু হল তাঁর অনুযোগ। স্থানীয় একটি বিড়ির ব্র্যান্ডের কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘‘লাল সুতোর প্যাকেট নিলে অর্ধেক বিড়ি ফাটা বেরোচ্ছে।’’ তাঁকে জোরালো সমর্থন জানালেন আরও কয়েক জন। আলোচনায় ঢুকে পড়ল অন্য একটি ব্র্যান্ডের সবুজ সুতোর বিড়িও।
আরও এক বার মনে হল, সালিশি আদালতের টাটা-রায়ের পরের দিন সকালের সিঙ্গুরের আলোচনায় বিড়ি আছে, কিন্তু গাড়ি, কারখানা, জমি, শিল্পনীতি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেন, গোপালকৃষ্ণ গান্ধী— কেউ নেই। কিচ্ছু নেই।
সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন এখন স্কুলবইয়ে পাঠ্য। রাজ্য রাজনীতির ইতিহাস লেখা হলেও একটি বড় অধ্যায় খরচ হবে সিঙ্গুরের জন্য। কিন্তু সেই ইতিহাস বোধহয় ঘাঁটতে চায় না সিঙ্গুর। যেমন এলাকার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী বেচারাম মান্না বললেন, ‘‘রায় নিয়ে আমি কিছু বলব না। যা বলার শিল্পমন্ত্রী বলবেন।’’ কিন্তু সিঙ্গুরের মানুষ? বেচারামও স্পষ্ট বলে দিলেন, ‘‘লোকের কোনও আগ্রহ নেই।’’ সিঙ্গুরের প্রাক্তন বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী ‘মাস্টারমশাই’ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘পাস্ট ইজ় পাস্ট।’’ মাস্টারমশাই গত ভোটের আগে বিজেপিতে গিয়েছিলেন। প্রার্থী হয়ে পরাস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। যেমন টাটা থেকে অনেক দূরে সিঙ্গুর।
সিঙ্গুর থেকে হাওড়া পর্যন্ত রেলের লাইন ধরে এখনও ছোটে ‘আন্দোলন লোকাল’। কিন্তু সিঙ্গুর আর অতীতের লাইনে নামতে চায় না।