চেখে দেখা। —নিজস্ব চিত্র।
রাজকুমার রাও অভিনীত ‘নিউটন’ সিনেমার দৃশ্য। মালকো নামে আদিবাসী ভোটকর্মীটি নির্বাচনী আধিকারিককে লাল পিঁপড়ে ভরা গাছের ডাল দেখাচ্ছিল। জানিয়েছিল, এ পিঁপড়ে তাদের প্রিয় খাবার।
সিনেমার প্রেক্ষাপট ছত্তীসগঢ়। তবে লাল পিঁপড়ে অর্থাৎ কুরকুট এ রাজ্য, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশাতেও জনজাতির প্রিয় খাবার। খাবারের কোনও সীমানা হয় না। কুরকুটেরও হয়নি। জঙ্গলবাসীদের প্রিয় এই খাবারে নাগরিক আগ্রহও বেড়েছে। ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ির বিভিন্ন হোম স্টে-তে মিলছে কুরকুটের চাটনি, ঝোলও। বেশ দাম দিয়েই তা খাচ্ছেন পর্যটকেরা। যেমন, পাহাড়ে বেড়াতে গেলে স্থানীয় খাবার, পানীয়ে মজে যান পর্যটকেরা। যেমন, বিদেশেও বহু জায়গায় বেড়াতে গিয়ে স্থানীয় খাবার পছন্দ করেন অনেকে।
সম্প্রতি ওড়িশায় সিমলিপালের কুরকুটের চাটনি জিআই ট্যাগ পেয়েছে। বাংলায় অবশ্য কুরকুটে রাজনীতি জড়িয়ে। জঙ্গলমহলের মানুষ লাল পিঁপড়ের ডিম খেয়ে বাঁচে— দু’দশক আগে আমলাশোলে অনাহারে পাঁচ আদিবাসীর মৃত্যুর অভিযোগের পরে এমনই ‘তথ্যে’ বিদ্ধ হয়েছিল বাম সরকার। যদিও স্থানীয়দের দাবি, আদিবাসী-মূলবাসীদের চিরন্তন সুখাদ্য এই কুরকুট। সাধারণ মানুষজনও কুরকুটের চাটনি বা ঝোল খান।
বেলপাহাড়ি টুরিজ়ম অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র বিধান দেবনাথ বলছেন, ‘‘জঙ্গমহলের মানুষ পিঁপড়ের ডিম খেয়ে বাঁচেন, এটা সর্বৈব মিথ্যা। পিঁপড়ের ডিম অনেক মূলবাসী পরিবার সুখাদ্য হিসেবে ভেজে অথবা বেটে খান। সবচেয়ে জনপ্রিয় হল লাল পিঁপড়ে বা কুরকুট।’’ বেলপাহাড়ির সিঙাডোবার শোভা মুড়া জানাচ্ছেন, কাঁচা কুরকুট কাঁচালঙ্কা, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, কয়েক ফোঁটা সরষের তেল আর নুন দিয়ে বাটলেই তৈরি চাটনি। আর তেজপাতা দিয়ে তেলে সাঁতলানো কুরকুট বাটায় জল দিয়ে ফোটালেই তৈরি কুরকুটের ঝোল। বেলপাহাড়ির ইন্দিরা চকের একটি খাবারের দোকানের কর্মী নরেন মাহাতো বলছেন, ‘‘পর্যটকরা কুরুকুটের চাটনিই বেশি পছন্দ করছেন। একশো গ্রামের দাম একশো টাকা। তাতে ৮-৯ জন স্বাদ নিতে পারবেন।’’
ঢাঙিকুসুমের এক হোম স্টে-র মালিক অশ্বিনী পাত্র বললেন, ‘‘পর্যটকদের কুরকুটের চাটনি কাঁচা শালপাতায় পরিবেশন করা হয়। কাঁচা কুরকুট বাটাকে অনেকে কুরকুটের আচারও বলে।’’ অশ্বিনীর হোম স্টেতে সেই চাটনি চেখে কোন্নগরের সুমিত মুখোপাধ্যায়, পার্থ দেব, কসবার সুদেষ্ণা মিত্র, গল্ফগ্রিনের মৈত্রেয়ী সেন ভেবেছিলেন, প্রচুর তেঁতুল দিয়ে তৈরি। সুদেষ্ণা বলছেন, ‘‘পিঁপড়ে যে এত টক হতে পারে, ভাবিনি।’’ সিঙাডোবার শঙ্খ অধিকারী জানালেন, ওড়িশার সিমলিপালে কুরকুটের চাটনি (কাই চাটনি) ভীষণই জনপ্রিয়। নতুন বছরের ২ জানুয়ারি সিমলিপালের কাই চাটনি ভৌগোলিক চিহ্ন (জিয়োগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পেয়েছে।
বর্ষার দুটো মাস বাদে জঙ্গলের গাছে কুরকুট বাসা বাধে। তা জঙ্গলমহলে অর্থনীতির অঙ্গও। এলাকাবাসী হাটে প্রতি কিলোগ্রাম ৩০০-৪০০ টাকায় কুরকুট বিক্রি করেন। মহাজনদের আনাগোনাও রয়েছে এলাকায়। তাঁরা কুরকুটের ডিম কেনেন ৬০০-৭০০ টাকা কিলোয়। কলকাতার বাজারে তার দর ওঠে দেড় থেকে দু’হাজার টাকা। মৎস্য শিকারিরা এই পিঁপড়ের ডিম মাছের চার হিসাবে ব্যবহার করেন। তার দাম আরও বেশি।
পিঁপড়ের চাটনিতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, বিশ্বাস স্থানীয়দের। আমরোলার ভটে শবর, ভৈরব শবররা বলছেন, ‘‘আমাদের রোজদিনের পাতের খাবার কলকাতার বাবুরা দাম দিয়ে খাচ্ছেন। অনেকে গ্রামে এসেও এর খোঁজ করেন।’’
সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে কলকাতার বদ্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে চার যুবক জঙ্গলে বোহেমিয়ান হয়ে উঠেছিল। পাহাড় জঙ্গলের মাঝে বেলপাহাড়িও এখন পর্যটকদের হাতছানি দিচ্ছে কুরকুটের চাটনি চেখে দেখার!