তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। —ফাইল চিত্র।
মনোনয়ন এবং ভোটদানের পরে গণনা নিয়েও গুরুতর প্রশ্নের মুখে পড়ল সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচন। আর সেই সূত্রেই এই ফলের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরে। সামগ্রিক ভাবে এই ফলকে দলের পক্ষে রায় বলে উল্লেখ করা হলেও রাজ্য ও জেলা স্তরের অনেকেই মনে করছেন, এমন ভোটের প্রভাব দেখা যেতে পারে আসন্ন লোকসভা ভোটে। ঠিক যে ভাবে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে গা-জোয়ারির অভিযোগের ফল ভুগতে হয়েছিল ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে।
গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি তো আছেই, মঙ্গলবার বেশি রাতে গণনা শুরু হওয়ায় সংশয়ের কেন্দ্রে রয়েছে জেলা পরিষদের জয়- পরাজয়। তৃণমূল সূত্রেই খবর, একাধিক জেলায় জেলা পরিষদের ব্যালট গণনার সময় বিরোধীদের প্রতিনিধি ছিলেন না। সেই সুযোগে ভোটের ফলে তার প্রতিফলন ঘটে থাকলে তা সামগ্রিক ভাবে জনমনে প্রশ্ন তুলতে পারে। বিশেষ করে, গত লোকসভা ও পরে বিধানসভা ভোটে যে সব জায়গায় বিরোধীরা ভাল ফল করেছে, সে সব জায়গায় তৃণমূলের এ বার একচেটিয়া জয় নিয়ে সন্দেহের অবকাশ তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। শাসক দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘জনপ্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে কোনও স্তরই বিরোধীশূন্য হওয়া উচিত নয়। জেলা পরিষদ একেবারে বিরোধীশূন্য হলে স্বচ্ছতার অভাব তৈরি হতে পারে। এই অভিজ্ঞতা আমাদের আছে।’’
পাঁচ বছর আগে পঞ্চায়েত ভোটে শাসক তৃণমূলের জয়ের মধ্যেও কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়। তিন স্তরে প্রায় ৩৪% আসনে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেনি। তার ঠিক কয়েক মাসের মধ্যে লোকসভা ভোটে রাজ্যে ১৮ আসনে জয় পেয়ে উত্থান হয়েছিল বিজেপির। তৃণমূলও দলের নানা স্তরে লোকসভা ভোটে তাদের সেই ‘ধাক্কা’র কারণ হিসেবে পঞ্চায়েতের গা-জোয়ারিকেই চিহ্নিত করেছিল। এ বারও সামগ্রিক ভাবে পঞ্চায়েত ভোট এবং নির্দিষ্ট করে জেলা পরিষদের গণনা প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় সেই চর্চা ফিরেছে শাসকের অন্দরেও।
এই রকম জেলার অন্যতম উত্তরের আলিপুরদুয়ার। জেলার সাংসদ ও বিধায়ক সবই বিজেপির হওয়া সত্বেও জেলা পরিষদ বিরোধীশূন্য। জেলা পরিষদে ১৮ আসনের সব ক’টিই তৃণমূলের দখলে। এমনকি, ২০১৮ সালে বিতর্কিত পঞ্চায়েত ভোটেও যে একটি আসন বিজেপির হাতে ছিল, এ বার তা-ও পায়নি তারা। একই ভাবে দক্ষিণবঙ্গের পুরুলিয়ায় গত পঞ্চায়েত ভোটেও জেলা পরিষদে বিরোধীদের উপস্থিতি ছিল নজরে পড়ার মতো। গত ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদের ৩৮ আসনের মধ্যে বিরোধী বিজেপি পেয়েছিল যথাক্রমে ৯ এবং কংগ্রেস পেয়েছিল ৩টি। তৃণমূল পেয়েছিল ২৬টি। এ বার পুরুলিয়া জেলা পরিষদে কংগ্রেস কোনও আসনই পায়নি। বিজেপি মাত্র একটি আসন পেয়েছে। আর তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ এক প্রার্থী জিতেছেন। প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে ১৫ আসনের এই জেলায় বিজেপি পেয়েছিল ৭ টি।
গ্রাম পঞ্চায়েতে বিরোধীরা শাসক দলের সঙ্গে মোকাবিলা করে আসন বার করতে পেরেছে কিন্তু জেলা পরিষদে গিয়ে বিরোধীরা কার্যত অস্তিত্বহীন, এমন উদাহরণ এ বার অজস্র। শাসকের এই ‘ম্যাজিকে’র ব্যাখ্যায় আলিপুরদুয়ার জেলা তৃণমূলের সভাপতি প্রকাশ চিক বরাইক বলেন, ‘‘জেলার সব বন্ধ চা-বাগান খোলার ব্যবস্থা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তা ছাড়া ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প সব অংশের মানুষের সমর্থন আদায় করেছে।’’ তাঁর দাবি, আলিপুরদুয়ারের মানুষ লোকসভা ও বিধানসভায় বিজেপিকে ভোট দিলেও তাঁরা এই জেলার মানুষের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখেনি। তারও প্রভাবও রয়েছে জনমতে। পুরুলিয়া জেলা তৃণমূল সভাপতি সৌমেন বেলথরিয়ার দাবি, ‘‘দলের কর্মীরা সারা বছর মানুষের পাশে থেকে নেত্রীর আদর্শকে সামনে রেখে কাজ করছেন। ভোটে তাই মানুষ ওঁদের নয়, আমাদেরই সমর্থন করেছেন।’’