বাগ্যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন দুই সাংসদ অর্জুন সিংহ এবং সৌগত রায়। ফাইল চিত্র।
ব্যারাকপুরকাণ্ডে তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই ঝাড়খণ্ড-যোগ স্পষ্ট হচ্ছে। আনন্দপুরী এলাকার সোনার দোকানে ডাকাতি ও খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে জামশেদ আনসারি গ্রেফতার হওয়ার পর তেমনটাই মনে করছেন তদন্তকারীদের একাংশ। জামশেদ ছাড়াও ওই ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন সফি খান নামে আর এক জন। তদন্তকারীদের দাবি, জামশেদ ও সফিই ঘটনার দিন গুলি চালিয়েছিলেন। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার রাতে সিসি ক্যামেরার ফুটেজের সূত্র ধরে খোঁজ মেলে রহড়া থানা এলাকায় লুকিয়ে থাকা সফিরের। এর পর তাঁর সূত্রেই জামশেদের সম্পর্কে জানতে পারেন তদন্তকারীরা। ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দা সূত্রে খবর, শুক্রবার সকালে বীরভূমের মুরারই থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। জামশেদ ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জে পালানোর চেষ্টা করছিলেন বলে তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে।
বুধবার সন্ধ্যায় টিটাগড় থানা এলাকার একটি সোনার দোকানে গুলি চলে। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দোকানের মালিক নীলরতন সিংহের পুত্র নীলাদ্রি সিংহের। জখম হন নীলরতন এবং দোকানের নিরাপত্তারক্ষী শঙ্কর চক্রবর্তী। ভরসন্ধ্যায় এই ডাকাতি ও খুনের ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির প্রশ্নে বিবৃতি এবং পাল্টা বিবৃতি দিয়ে একে অপরের সঙ্গে বাগ্যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন দুই সাংসদ অর্জুন সিংহ এবং সৌগত রায়। অর্জুন ব্যারাকপুরের সাংসদ (খাতায়কলমে বিজেপির)। আর সৌগত তার অনতিদূরের লোকসভা কেন্দ্র দমদমের তৃণমূল সাংসদ। ব্যারাকপুরের সোনার দোকানে ডাকাতি এবং ডাকাতদের গুলিতে দোকানের মালিকের যুবক পুত্রের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে শোরগোল পড়েছে। সেই প্রেক্ষিতেই এলাকার সাংসদ হিসেবে পুলিশের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন অর্জুন। যা তাঁর এখনকার দল তৃণমূলকে ‘অস্বস্তি’তে ফেলেছে। সৌগত আবার প্রকাশ্যেই অর্জুনের সমালোচনা করেছেন। তাতে আরও ‘বিড়ম্বনা’ বেড়েছে শাসকদলের অন্দরে। তা নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না বিরোধীরা।
ব্যারাকাপুর কাণ্ডের তদন্ত
তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, দুষ্কৃতীরা ঘটনাস্থলে কিছু সূত্র ছেড়ে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম, তাঁদের ফেলে যাওয়া একটি ব্যাগ। আর সিসিটিভি ফুটেজ। সেই ফুটেজের সূত্র ধরেই উত্তর ২৪ পরগনা ও হাওড়ার পরিবহণ দফতরে নথিভুক্ত দু’টি মোটরবাইকের নম্বর জানা গিয়েছে। সোনার দোকানের পাশেই দু’টি ব্যাঙ্কের এটিএম আছে। সেগুলির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং ওল্ড ক্যালকাটা রোডের বেশ কয়েকটি আবাসনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজের সূত্রে বাইক দু’টিকে চিহ্নিত করা গিয়েছে। সেই সূত্রেই রহড়া থেকে সফি গ্রেফতার হন।
ব্যারাকপুর কাণ্ডে ঝাড়খণ্ড-যোগ
জামশেদ ও সফিকে গ্রেফতারের পর শনিবার ব্যারাকপুর আদালতে হাজির করানো হয়। বিচারক তাঁদের ১৪ দিন পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁদের জেরা করে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, জামশেদ সম্পর্কে সফির মামা। এ ছাড়া বিভিন্ন পুরনো নথি ঘেঁটে জানা গিয়েছে, গত দুর্গাপুজোর আগে একটি চুরির ঘটনায় ধরা পড়ে জেল খেটেছিলেন কামারহাটির বাসিন্দা সফি। ছাড়া পেয়ে ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জে মামা জামশেদের কাছে চলে যান তিনি। সেখানেই বাকি সঙ্গীদের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। পুলিশের দাবি, ব্যারাকপুরের দু’টি সোনার দোকানে ‘রেইকি’ করেন সফি। ডাকাতি করে পালানো সহজ হবে, এই যুক্তিতেই তিনি ওল্ড ক্যালকাটা রোডের দোকানটি ডাকাতির জন্য বেছে নেন। এর পরেই ঝাড়খণ্ড থেকে বাকি সঙ্গীদের ডেকে আনা হয়। আগ্নেয়াস্ত্রও পড়শি রাজ্য থেকেই আসে।
প্রথম ‘টার্গেট’ হাওড়ার দোকান?
তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, ব্যারাকপুরের আনন্দপুরীর সোনার দোকানটি দুষ্কৃতীদের প্রথম টার্গেট ছিল না। তাদের নজরে ছিল হাওড়ার কদমতলার একটি সোনার দোকান। তদন্তকারীদের কাছ থেকে সেই কথা জানতে পেরে আতঙ্কে ভুগছেন সেই দোকানের মালিক যিশুকৃষ্ণ আড়ি। তিনি জানান, শুক্রবার সকালে সন্দেহভাজন দুষ্কৃতীদের নিয়ে তাঁর দোকানে উপস্থিত হন হাওড়া সিটি পুলিশ এবং ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পদস্থ কয়েক জন কর্তা। ওই ডাকাতদলের কী পরিকল্পনা ছিল, কোথা থেকে কোন পথে তারা যাতায়াত করেছে— এমন নানা তথ্য আটক হওয়া দুষ্কৃতীদের কাছে জানতে চায় পুলিশ। সেখান থেকেই যিশু জানতে পারেন যে ব্যারাকপুরের আগে তাঁর দোকানই ছিল ডাকাতদের প্রথম টার্গেট। যিশু বলেন, ‘‘ছক ছিল ২৪ মে, মঙ্গলবার আমার দোকান লুট করা হবে। সেই মতো ওই দিন সকাল সকাল দোকানের কাছে চলেও এসেছিল দুষ্কৃতীরা। পুলিশের থেকে জানতে পারলাম, সকাল থেকে দোকানে খুব ভিড় থাকায় ছক পাল্টে ফেলে তারা।’’
বড় আন্দোলনের হুঁশিয়ারি
সোনার দোকানে ডাকাতি এবং খুনের ঘটনার প্রতিবাদে শনিবার এলাকায় ২৪ ঘণ্টার বন্ধ পালন করলেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। সকাল থেকেই বন্ধ ছিল গয়নার দোকানগুলি। অন্যান্য দোকান খোলা থাকলেও বাজারে ভিড় কমই ছিল। গাড়িও কম চলেছে। ব্যারাকপুর স্টেশন থেকে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা একটি প্রতিবাদ মিছিল বার করেন। সেই মিছিল পৌঁছয় ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট পর্যন্ত। এর পর তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তার দাবিতে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটে স্মারকলিপি জমা দেন। মিছিলটি ব্যারাকপুর চিড়িয়া মোড় পেরনোর পরেই অবশ্য স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের আটকে দেয় পুলিশ। এর পর স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল কমিশনারেটে পৌঁছয় স্মারকলিপি দিতে। বঙ্গীয় স্বর্ণ শিল্পী সমিতির সম্পাদক টগর পোদ্দার বলেন, ‘‘স্বর্ণ শিল্পীদের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। না হলে আরও বড় আন্দোলন হবে ভবিষ্যতে।’’
সৌগত-অর্জুন বাগ্যুদ্ধ
ব্যারাকপুরের ঘটনার পর অর্জুন বলেছিলেন, ‘‘যেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নেই, সেখানে নিজে ভিভিআইপি নিরাপত্তা নিতে লজ্জা হয়! ব্যারাকপুরের সাংসদ হয়ে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারছি না। এ দিকে আমি নিজে ভিভিআইপি নিরাপত্তা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি!’’ অর্জুনকে সমর্থন করেছিলেন কামারহাটির তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্র। কিন্তু অর্জুনের বিরোধিতা করে প্রবীণ সাংসদ সৌগত বলেন, ‘‘অর্জুন সিংহের এমনটা বলা ঠিক হয়নি। এখন যদি অর্জুন সিংহ রোজ পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন, তা হলে তো পার্টি এ সব ভাল ভাবে নেবে না।’’ পাল্টা অর্জুন বলেন, ‘‘সৌগত রায় তিন মাস আগে কী বলেছেন, আর তিন মাস পরে কী বলছেন, তার মধ্যেই বিস্তর ফারাক থাকে! তাঁর কথার আমি কী আর জবাব দেব?’’ ঘটনাচক্রে, সৌগতও শুক্রবার ব্যারাকপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমালোচনা করেছিলেন। তার পরেই গোটা বিষয়টিই বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠেছে।
বিড়ম্বনায় শাসকদল
সৌগত-অর্জুন দ্বন্দ্ব যে দিকে গড়িয়েছে, তাতে শাসক তৃণমূলের ‘বিড়ম্বনা’ বৃদ্ধি পাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সৌগতের সঙ্গে বিজেপি ছেড়ে ফের তৃণমূলে আসা অর্জুনের বিবাদ আর যাতে না বাড়ে, সে বিষয়ে নজর রাখছেন দলের শীর্ষনেতৃত্বও। তবে ‘বিড়ম্বনা’ মেটাতে দলের অন্দরে পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পৃথক ভাবে সৌগত এবং অর্জুনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান দমদম ও ব্যারাকপুর সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের সভাপতি তাপস রায়। দলের একাংশের অনুমান, তাপসের মারফৎ দু’পক্ষের কাছেই আপাতত ‘মুখ বন্ধ’ রাখার বার্তা পাঠানো হতে পারে। তবে তাপসও প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ।
কটাক্ষ সুজন, শমীকের
দুই তৃণমূল সাংসদের বিবাদ নিয়ে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘গোটা রাজ্যেই আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। ব্যারাকপুরের ঘটনায় যেটা আরও স্পষ্ট হল। অর্জুন সিংহ তো ঠিকই বলেছেন। কিন্তু সৌগত চাইছেন না, তাঁর সতীর্থ এমন কথা বলুন। উনি চাইছেন, অর্জুন শুধুই জুটমিল নিয়ে বলবেন!’’ বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন অবনতি থেকে নজর ঘোরানোর জন্য তৃণমূল এই ধরনের অবস্থা তৈরি করে। অর্জুন সিংহ যখন বিজেপিতে ছিলেন, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে এই ধরনের কথা আরও বেশি করে বলতেন। এখন উনি তৃণমূলে। এই ধরনের মানুষের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। আর সৌগতবাবু যখন তখন দলের বিবেক হয়ে ওঠেন!’’