রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
স্বরাষ্ট্র বাজেটে বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণের সুযোগ ছা়ড়া যাবে না বলে তাঁর বৈঠকের আহ্বান খারিজ করে দিয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। কিন্তু যে দিন মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস পরিষদীয় দলের সঙ্গে বৈঠকের জন্য সময় দিয়েছিলেন, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সেই দিনই কংগ্রেসের দুই বিধায়ক আলাদা ভাবে দেখা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে! যার জেরে ফের জল্পনা শুরু হল কংগ্রেসের মধ্যে বিভাজন নিয়ে।
প্রথম জন, মালদহের রতুয়ার সমর মুখোপাধ্যায়। তাঁর এলাকার একটি প্রকল্পের উদ্বোধনের অনুরোধ নিয়ে তিনি শুক্রবার বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। দ্বিতীয় জন, কংগ্রেসের বর্ষীয়ান বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। কাটোয়ার এই বিধায়ক মমতার দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁর এলাকার আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নিয়ে। পুরভোটের সময় তাঁর বিরুদ্ধে খুনের মামলা দিয়ে তাঁকে যে ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে ও দলের ঘরছাড়া কর্মীদের প্রসঙ্গ রবিবাবু তোলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে।
প্রথম জনের মমতা-সাক্ষাৎ নিয়ে তেমন বিতর্ক না হলেও জল্পনা বেড়েছে দ্বিতীয় জনকে নিয়েই। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আগে বা পরে কংগ্রেস পরিষদীয় দলের অনুরোধ মেনে রবিবাবু এ দিন সভায় ঢোকেননি। তৃণমূল সূত্রের খবর, তাঁর বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা মামলা’র অভিযোগ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই রবিবাবুকে শাসক দলে যোগ দেওয়ার কথা ‘ভেবে দেখতে’ অনুরোধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কংগ্রেসের মধ্যেও গুঞ্জন, তবে কি মামলা থেকে বাঁচার তাগিদে কাটোয়ার দীর্ঘ দিনের কংগ্রেস নেতা তৃণমূলের দিকেই ঝুঁকে প়ড়ছেন? যদিও মমতার কক্ষে বৈঠকের পরে রবিবাবুর দাবি, ‘‘কাটোয়ার সাম্প্রতিক কিছু সমস্যা নিয়ে আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। ওখানে শাসক দল যে ভাবে সন্ত্রাস চালাচ্ছে এবং বিধায়ক হিসেবে কাজ করতে যে আমার অসুবিধা হচ্ছে, সে কথা মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছি।’’ তাঁর অভিযোগ শুনে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য পুলিশের ডিজি-র মাধ্যমে জেলার পুলিশ সুপার এবং স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে সরকারি সূত্রের খবর। এমনকী, মন্ত্রিসভার সতীর্থ অরূপ বিশ্বাসকেও বিষয়টি নজর রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
রবিবাবুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকে রাজনৈতিক রঙে দেখতে চাননি মমতাও। তাঁর দাবি, এলাকায় বিধায়ক তহবিলের টাকা খরচ নিয়ে কথা বলতে এসেছিলেন রবিবাবু। মমতার বক্তব্য, ‘‘উনি একটা অন্য দল করেন। উনি তো আমার কাছে আসতেই পারেন। অনেক দরকার থাকতে পারে। এই তো ওঁর আগে রতুয়ার কংগ্রেস বিধায়ক সমর মুখোপাধ্যায়ও এসেছিলেন।’’
কিন্তু জল্পনা তাতে থামছে না। পরের বার বিধানসভা ভোটে নিজেদের কেন্দ্রে জয়ের ব্যাপারে যাঁরা নিশ্চিত নন এবং যাঁদের সঙ্গে প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরীর মনোমালিন্য চলছে, তাঁরাই সুয়োগ মতো তৃণমূলের প্রতি ‘দুর্বলতা’ দেখাচ্ছেন বলে কংগ্রেসেরই একাংশের ব্যাখ্যা। বস্তুত, তৃণমূলের সঙ্গে ভবিষ্যতের সমীকরণ কেমন হবে, সেই প্রশ্নে রাজ্য কংগ্রেস এখন দুই শিবিরে বিভক্ত। রবিবাবু যদিও এ দিন দাবি করেছেন, ‘‘আসলে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করছি, এ কথা জানাজানির পরে জল্পনা বেশি হচ্ছে!’’ স্বরাষ্ট্র বাজেটে অংশ নেওয়ার জন্য কংগ্রেস পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব রবিবাবুকে অনুরোধ করেছিলেন বলে দলীয় সূত্রের খবর। কিন্তু রবিবাবুর যুক্তি, ‘‘সোহরাবদা আমাকে বলতে বলেছিলেন। কিন্তু আমার ওখানে যা গোলমাল চলছে, তাতে আমি এ দিন কলকাতায় থাকতে পারব কি না, তা নিয়েই সংশয় ছিল। তাই আমি রাজি হইনি।’’ স্বরাষ্ট্র বাজেটে অংশ নিয়ে কংগ্রেসের দুই বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী ও অসিত মিত্র যখন কাটোয়ার ঘটনা নিয়ে সরব হয়েছেন, তখন অধিবেশনে না থেকে স্বয়ং রবিবাবু মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চলে যাওয়ায় জল্পনা আরও গতি পেয়েছে!
জল্পনায় ইন্ধন জুগিয়েছে মানস ভুঁইয়াকে ঘিরে এ দিনের ঘটনাপ্রবাহও। স্বরাষ্ট্র-বিতর্কে অংশ নেননি মানসবাবু। মুখ্যমন্ত্রী সভায় আসার আগেই উল্লেখ-পর্বে তিনি রাজ্য ‘বারুদের স্তূপের উপরে বসে আছে’ বলে মমতার বিবৃতি দাবি করে রেখেছিলেন। কিন্তু বাজেটের জবাবি ভাষণে মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎই মঙ্গলকোটের পুরনো ঘটনা টেনে মন্তব্য করেন, ‘‘মানসদা’র সেই বাঁচাও বাঁচাও বলে দৌড় আমার মনে আছে! এখন কি আর কেউ কাউকে মারতে তাড়া করে?’’ মানসবাবুকে কাছে টানার প্রয়াস আরও জোরালো করে মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের কাছ থেকে রাজ্যের দাবি আদায়ে তাঁকে ও সোহরাবকে সামিল হওয়ার আবেদনও জানান। তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে মানসবাবু মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘‘বিজেপি-র বিরুদ্ধে আপনি বলুন। তা হলে আমরা আছি!’’
মানসবাবুর এমন মন্তব্যে অন্য গন্ধ পাচ্ছে কংগ্রেসেরই একাংশ! আর এই বিভাজন কাজে লাগাতে তিনিও যে উৎসুক, তার ইঙ্গিত দিয়ে মমতাও পরে বলেছেন, ‘‘আমার দরজা সকলের জন্যই খোলা! ওঁদের দলে কেউ বারণ-টারণ করতে পারেন। সেটা অবশ্য আমার জানা নেই!’’